আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম একটি দূর্লভ জিনগত ভিন্নতা। মানুষের শরীরের ১৫ নম্বর ক্রোমোজোমের একটি জিনের (UBE3A জিন) অস্বাভাবিক পরিব্যপ্তির কারনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকার, পরিপূর্ণভাবে কথা বলতে না পারা, ঘুমে অনিয়ম, কোনো কিছু গিলতে(গলাধঃকরণ) না পারা, শরীরের ক্রমবিকাশমান ধারাবাহিকতা (Developmental milestone) বজায় না থাকা, হাত পায়ের নড়চড়সহ অন্যান্য ঐচ্ছিক পেশিসমূহ পরিচালনে ভারসাম্য না থাকা- এরকম কতগুলো শারীরিক ত্রুটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম বলা হয়। এই সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। পনের নম্বর ক্রোমোজোমের UBE3A জিনের মায়ের অ্যালিলটি না থাকাকেই এখন পর্যন্ত আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমের কারন হিসেবে মনে করা হয়।
এই সিন্ড্রোমের লক্ষণসমূহ জন্মের ৬ মাস ১বছরের দিকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালের আগ পর্যন্ত এই জেনেটিক ত্রুটি প্রাডের-উইলি সিন্ড্রোমের একটি প্রকার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ব্রিটিশ শিশুচিকিৎসক হ্যারি আ্যান্ঙ্গেলম্যান ১৯৬৫ সালে এই সিন্ড্রোমটির বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং নাম দেন হ্যাপি প্যাপেট সিন্ড্রোম, যদিও পরবর্তীতে এটি আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এই সিন্ড্রোমটি খুব বেশি দিন পুরোনো আবিষ্কার না হওয়া এবং দূর্লভ হবার কারনে অনেকেই এটি সম্পর্কে অবগত নয়। এটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা না থাকার কারণে প্রায়শই আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমকে অটিজম কিংবা সেরেব্রাল পালসি ভেবে চিকিৎসা দেয়া হয়। অনেক গবেষক মনে করেন আ্যন্গেলম্যান সিন্ড্রোম বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৯৯ সালে একজন আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম আক্রান্ত মায়ের সন্তান আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার ইতিহাস আছে, যদিও এর পরে কখনো এরকম ঘটনা দেখা যায়নি। আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম এর ব্যাপারে তেমন কোনো জরিপ এখনো না পাওয়া গেলেও যে কয়টি বিশ্বস্ত জরিপ আছে তারমধ্যে সুইডিশ একটি জরিপে দেখা যায় প্রতি ২০,০০০ জন নবজাতকের মধ্যে একজন এবং ডেনমার্কের জরিপে দেখা যায় প্রতি ১০,০০০ জনে একজন এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত।
লক্ষণসমূহ: আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম যেহেতু জিনগত ত্রুটি আর সবার জিনগত ত্রুটি একেবারে একরকম নয় যেমন- কারো হয়তো জিনটি একেবারেই অনুপস্থিত আবার কারো জিনের কোনো একটি অংশ অনুপস্থিত, তাই একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকমের লক্ষণ প্রকাশ কর। তবুও বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যা সব আ্যাঙ্গেলম্যানদের মধ্যেই দেখা যায় যেমন-
- শরীরের ক্রমবিকাশমান ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা যেমন যেই বয়সে যতটুকু শারীরিক বিকাশ হবার কথা তা না হওয়া। বিশেষ করে মোটর বিকাশের ধারাক্রমে পিছিয়ে থাকা।
- মুখে বোল না ফোটা অর্থাৎ সময়মতো কথা না বলা বা আধো আধো কথা বলা। যেমন সাধারনত শিশু ছয় মাসের আগেই বা…বা…মা….দা.. এরকম ব্যাবলিং করে, এক বছরে একটি শিশু কমপক্ষে একটি শব্দ বলতে শিখে – এরকম স্বাভাবিকভাবে কথা না শেখা।
- Ataxia তথা শরীরের ঐচ্ছিক পেশিসমূহের সমন্বয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারা। ২-৪ বছর বয়স হয়ে যাবার পরও ভারসাম্যপূর্ণভাবে হাটতে না পারা।
- পেশিসমূহের কাঠিন্য (Rigidity) অথবা শিথিলতা (Relaxity)।
- খেতে না পারা। পাকস্থলীর অযাচিত প্রতিবর্তী ক্রিয়া যা খাবার ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়।
- হাত- পা এর অস্বাভাবিক এবং ঘনঘন নড়াচড়া করা।
- সূক্ষ্ম পেশিসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার দরুন অধিকাংশ আ্যাঙ্গেলম্যান আক্রান্তদের রাতে ঘুমের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত মূত্রত্যাগ দেখা যায়।
- অনিয়মিত ঘুম। খুব কম ঘুমানো আবার ঘুমালেও দ্রুত এবং বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া।
- সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকা। এরা কাঁদেননা বলেই চলে।
- Seizures অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের বিচ্ছিন্ন এবং অস্বাভাবিক ইলেকট্রনিক ইমপালস যা অস্বস্তি এবং শারীরিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান করে।
- এছাড়াও আ্যান্ঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের মধ্যে পানির প্রতি বিশেষ আগ্রহ মাথার আকৃতি ছোটো হওয়া এবং অতিচঞ্চলতা লক্ষ্য করা যায়।
রোগনির্ণয়ঃ
- রোগলক্ষণ এবং রোগ নির্দেশক এর সাথে পারিবারিক ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকগন প্রথমত আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম আছে কিনা তা ধারনা করেন
- EEG পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরাল পালস পর্যবেক্ষণ করা হয়।
- Chromosome Analysis, fluorescence in situ hybridisation, DNA methylation টেস্টের মাধ্যমে ১৫ নম্বর ক্রোমোজোমের ত্রুটি আছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম ডায়াগনোসিস করা হয়।
আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম রোগ চিকিৎসাঃ আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম যেহেতু জিনগত ত্রুটি তাই এটি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয় তবে সঠিক এবং নিয়মিত চিকিৎসা নিলে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করা সম্ভব।
- স্পিচ থেরাপি: আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের যেহেতু কথা বলা এবং গলাধঃকরণ নিয়ে সমস্যা থাকে তাই স্পিচ থেরাপি গ্রহন করলে এটি প্রায়শই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
- ফিজিওথেরাপি: পেশির কাঠিন্য-শৈথিল্য, ঐচ্ছিক পেশিসমূহের সমন্বয়ে ভারসাম্য না রাখতে পারা যেহেতু আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমের অন্যতম প্রধান সমস্যা তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা এখানে সহায়তা করে।
- বিহেভিওরাল থেরাপি: আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের মাঝে একই আচরণের পূনরাবৃত্তি, সবসময় হাসতে থাকা- এসবের জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে বিহেভিওরাল থেরাপি নিতে হয়।
- Anti-seizures medication: Seizures নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসকরা বিভিন্ন anti-seizures drug এবং চিকিৎসা প্রদান করেন।
- Sleeping medication: আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের ঘুমের সমস্যা দূর করতে চিকিৎসকরা ঘুমের ওষুধের পরামর্শ দেন।
সরাসরি আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমের কোনো প্রতিষেধক না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলোর বিপরীতে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম যেহেতু এখনো চলমান গবেষণার একটি বিষয় তাই গবেষকরা এখনো চেষ্টা করছেন আ্যাঙ্গেলম্যান প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য।
ব্রিটিশ সাহিত্যিক রিচার্ড প্রাইসের কন্যা আ্যাঙ্গেলম্যান আক্রান্ত তাই তার লেখা তিনটি কবিতার বই Hand held(1997), Lucky Day(2005), Small World (2012) এ আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশু এবং তার পরিবারের বিভিন্ন সময়ের কথা উঠে এসেছে। এছাড়া ২০১১ সালে। Budoy নামে ফিলিপাইনে একটি ধারাবাহিক টেলিভিশন নাটক প্রদর্শন করা হয়েছিল যেখানে Budoy নামে একজন আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম আক্রান্ত মানুষের জীবনধারা বর্ণনা করা হয়েছে।
পৃথিবীতে সবার জন্ম একভাবে হয়না। কেউ জন্ম নেয় পৃথিবীকে অন্য ভাবে দেখার জন্য, অন্য বার্তা দেবার জন্য। আমাদের এই যান্ত্রিক যুগে হাসি যখন দূর্লভ তখন আ্যাঙ্গেলম্যান মুখে ধারন করেন অবিরাম হাসি। সঠিক তথ্য জেনে সচেতন হওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মধ্য দিয়ে একজন আ্যাঙ্গেলম্যান সিন্ড্রোম আক্রান্ত মানুষ হয়ে উঠতে পারেন সদাহাস্য নিষ্পাপ একজন জীবিত Angel
তথ্যসূত্র:
১.https://rarediseases.org/rare-diseases/angelman-syndrome/
২ .https://youtu.be/F23XqZ3eMh8
৩.https://www.angelman.org/what-is-as/
৪.https://ghr.nlm.nih.gov/condition/angelman-syndrom
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।