আমরা মানুষ সভ্য সমাজে বাস করি, আমরা মানুষ কারন আমরা মানবিকতার পরিচয় দিতে জানি, আমরা মানুষ তাই একে অন্যকে তাদের বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই, আমরা মানুষ তাই একে অন্যকে ভালোবাসতে পারি, আমরা মানুষ কারন আমাদের মান মর্যাদা আছে, ভালো মন্দ বিচার করার মতো জ্ঞান বা বিবেক বুদ্ধি আছে, আছে সামাজিক স্ট্যাটাস।
আদিম যুগে আমরা ছিলাম অসভ্য, কালের আবর্তনে এখন আমরা হয়ে উঠেছি সভ্য, জীবন যাত্রার মান হয়েছে উন্নত থেকে উন্নতর।আমরা বর্তমানে বাস করছি এমন এক সমাজে যেখানে নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছি সমানতালে, পার করছি কর্মমুখর জীবন। নিজেকে ব্যাস্ত করে রাখছি কাজের মধ্যে কিন্তু আমরা যেন এই কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে কেমন কেমন যান্ত্রিকতা নিজেদের মধ্যে পুষে রাখতে শুরু করেছি, হযে যাচ্ছি যন্ত্রমানব। এখন কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে আমরা এতই ব্যাস্ত হয়ে পড়ি যে নিজের পরিবারকে পর্যন্ত ঠিকমত সময় দিতে পারি না এমন কি আমাদের নিজেদের সন্তানদেরকেও না। বাবা-মা দুইজনেই কর্মজীবী মানুষ। সকাল বেলা বের হই কাজের উদ্দেশ্যে সারা দিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরা হয় বড্ড ক্লান্ত হয়ে, কোন রকমে রাতের খবার শেষ করেই আবার বসে যাই কাজ নিয়ে, কাজ করতে করতে কখন যে রাত ভারি হয়ে আসে আর কখন যে আমরা ঘুমিয়ে যাই তা আমরা নিজেরাও জানিনা। আবার সকাল হতে না হতেই বের হয়ে পড়ি কাজের উদ্দেশ্যে কিন্তু ঐ যে আমাদের কোমলমতি সন্তানগুলো যারা সারাদিন তাদের বাবা মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকে যে কখন তাদের বাবা মায়েরা আসবে, কখন বাবা মা এসে তাদের উষ্ণ বাহুতে তাদেরকে আপন করে নেবে! সেই চাতক পাখির মত মা-বাবার পথ চেয়ে থাকা সন্তানগুলোকে আর ভালোবাসা হয় না, স্নেহ করা হয় না, তাদের সাথে কাটানো হয় না আনন্দঘন উপভোগ্য কোন সময়।
যান্ত্রিকতা আমাদের এমন ভাবে পেয়ে বসেছে যে আমরা আর আমাদের কোমলমতি সন্তানদেরকে বাসার চারদেয়ালের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখতেও দ্বিধাবোধ করি না, দ্বিধাবোধ করি না তাদের সুবিশাল পৃথিবীটাকে একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে। তালাবদ্ধ বাসায় শিশুগুলোর সময় কাটে বিভিন্ন ধরনের কার্টুন দেখে, ভিডিও গেম খেলে বা বাসার জনালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এই সুবিশাল পৃথিবীটা দেখার ব্যার্থ চেষ্টা করতে করতে। তাদের সুন্দর সুন্দর মিষ্টি কথা গুলো শোনার মতো কেউ থাকে না, তাদের সাথে খেলা করার মতো কোন সঙ্গীও থাকে না, থাকেনা ঘুমের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার মত কেউ। এমন কি যদি অসুস্থও হয় তখনও ঔষধ খাওয়াবার মতো সময় থাকে না বাবামায়ের কাছে। ঔষধটা খেতে হয় বাসার কোন কাজের বুয়া বা হাসপাতালের কোন নার্সের কাছ থেকে।
হাসি চাঞ্চল্যে ভরা শিশুটি ঘরের কোনায় সারদিন নিশ্চুপ একা বসে থাকতে থাকতে একসময় হয়ে যায় নির্বাক, কেমন যেন অদ্ভুত আচরন করতে শুরু করে সবার সাথে, নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখতে চায়, সবার আড়াল হয়ে থাকতে চায়, কথা বলতে ভুলে যায়।দায়িত্ববান বাবা মা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন তাদের সন্তানের এই অবস্থা দেখে। সন্তানকে নিয়ে ঘুরে ফেরেন এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তারের কাছে। সেবন করান দামি দামি সব ঔষধ কিন্ত তাতেও আর কাজ হয় না। দিন দিন সন্তানের এই অস্বাভাবিক আচরন বেড়েই চলে।তখন তারা আর কোন উপায়ান্তর না দেখে শিকল দিয়ে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখে পাগল আখ্যায় আখ্যায়িত করে। সমাজিক মান মর্যাদার কথা চিন্তা করে তাদেরকে লোক চক্ষুর আড়াল করে রাখে, সমাজে তাদের পরিচয় দিতে চায় না।আমরা মানুষ শিক্ষিত বিবেকবান, বুদ্ধিমান হওয়ার পরও যখন আমরা আমাদের সন্তানদের সাথে এমন অন্যায় আচরন করি তাতে কি আমাদের মানবিকতার বহিঃপ্রকাশে ভাটা পড়ে না?
নাকি এটা কোন সভ্য মানুষের আচরন হতে পারে? আমরা আমাদের মূল্যবান অলংকার, টাকা-পয়সা কোন সিন্ধুকে বা এমন কোন জায়গায় সংরক্ষন করি যাতে সেখান থেকে তার বিন্দু মাত্র কোন ক্ষতি না হয়। তা কিন্তু কখনই আমরা আমাদের বাসার কাজের বুয়ার কাছে রাখি না।কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানগুলোকে মাসের পর মাস বছরের পর বছর এই কাজের বুয়াদের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি আমাদের কর্মস্থলে। তাহলে কি আমাদের কাছে আমাদের সন্তানের মূল্য আমাদের সম্পদের চেয়ে কমে গেছে? আসুন এমন ভুল ধারনা থেকে বের হয়ে আসি। আর নিজেদের সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হই। যাতে করে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎগুলো আর নির্বাক হয়ে না যায়।