আ্যাফাসিয়া: একটি প্রাথমিক আলোচনা

মানুষ হলো সৃষ্টজগতের সেরা সৃষ্টি, আর তার কারণ মানুষের মধ্যে এমন কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, যেগুলো মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের কথা বলার ক্ষমতা বা ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা। ভাষার বন্ধনে এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে স্থাপন করতে পারে যোগাযোগীয় বন্ধন।

কিন্তু সব মানুষই সমান সক্ষমতার সাথে ভাষাকে ব্যবহার করতে পারে না বা ব্যবহার করার ক্ষমতা সবার সমান নয়। বিভিন্ন ত্রুটি মানুষের ভাষা ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা নিয়ে আসতে পারে। আর যেসব ত্রুটি মানুষের ভাষা অনুধাবন এবং ব্যবহার অর্থাৎ ভাষাভিত্তিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি অথবা প্রভাব ফেলে তাদেরকে ভাষা বৈকল্য বলা যেতে পারে। ভাষা বৈকল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষা বৈকল্য হলো আ্যাফেজিয়া। এটি হয়ে থাকে মূলত মস্তিষ্কের কোন ক্ষতির (impairment) কারনে। আ্যাফেজিয়া একটি অর্জিত (Acquired) ভাষা বৈকল্য।

মানুষের মস্তিষ্ককে প্রথমত দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথা: ডান হেমিস্ফিয়ার এবং বাম হেমিস্ফিয়ার। ভাষা উৎপাদন প্রক্রিয়াটি মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় বাম হেমিস্ফিয়ার থেকে। সুতরাং একথা বলাই যায় যে, বাম হেমিস্ফিয়ারের কোনো ক্ষতি বা ত্রুটি ভাষা উৎপাদন এবং ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে‌। উল্লেখ্য বাম হেমিস্ফিয়ারের ত্রুটি মনোযোগ ত্রুটি এবং স্মৃতিশক্তির র্দুবলতারও একটি মূল কারণ।

অ্যাফেজিয়া কোন কিছু বোঝা (comprehension), কথা বলা (speaking), পড়া (reading) এবং লেখার (writing) ক্ষেত্রে কঠিনতার সৃষ্টি করে। কিন্ত এটা বুদ্ধিবৃত্তিক(intelligence) কোন ত্রুটি নয়। মস্তিষ্কের এই ক্ষতির কারনে আ্যাফেজিয়ার পাশাপাশি মুখের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে আর যাকে বলা হয় dysarthria এবং শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে মুখের পেশীগুলো নড়াচড়া করতেও সমস্যা হতে পারে,এটাকে বলা হয় apraxia, খাবার গলাধঃকরণের (swallowing) ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে যাকে বলা হয় dysphagia।

আ্যফেজিয়ার লক্ষণ সমূহ

আ্যাফেজিয়ার কারনে মূলত কথাবলা (speaking), অনুধাবন (comprehention),পড়া (reading) এবং লেখার(writing) ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।

কথা বলার ক্ষেত্রে

  •  যা চিন্তা করে তা সহজ শব্দে বা কথায় প্রকাশ করতে না পারা।
  •  ভুল শব্দ বলা। যেমন আপনি মাছ বলতে গিয়ে তার কাছাকাছি একটা শব্দ গাছ বলা বা একেবারেই অন্য শব্দ বলা যেমন বলের পরিবর্তে রেডিও।
  •  শব্দের মধ্যে ধ্বনির স্থান পরিবর্তন করে ফেলা। যেমন কানের দুল বলতে গিয়ে দুলের কান বলে ফেলা।
  •  মিশ্র শব্দের ব্যাবহার করা।
  •  বাক্য বলার ক্ষেত্রে বেশি সময় নেওয়া।
  •  অর্থহীন বাক্য বলা।

বোঝার ক্ষেত্রে

  • লোকে যা বলে তা বুঝতে না পারা। এটা সাধারনত হয়ে থাকে যখন একটু দ্রুত কথা বলা হয়। বড় কোন বাক্য বোঝার ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে।
  •  হৈ চৈ পূর্ণ পরিবেশে অথবা দলগত পরিবেশে কথা না বুঝতে পারা। কৌতুক বা হাস্যরস বোঝার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়।

 

পড়া এবং লেখা

  •  পত্রপত্রিকা,বই এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনে পড়তে সমস্যা হয়।
  •  বানান এবং একসাথে শব্দ যোগ করে বাক্য তৈরী করতে।
  •  সংখ্যা ব্যাবহার এবং অঙ্ক কষার ক্ষেত্রে।যেমন সময় বলার ক্ষত্রে, টাকা গননার ক্ষেত্রে।

আ্যফেজিয়ার কারণসমূহ

আ্যাফেজিয়া মূলত হয়ে থাকে ব্রেইন স্ট্রোকের কারনে। এছাড়াও এটা হতে পারে যে কোন ধরনের brain damage এর কারনে। যেমনঃ ব্রেইন টিউমার বা ব্রেইনে কোন ধরণের আঘাত ইত্যাদি।

আ্যাফেজিয়ার ধরণসমূহ

 Wernicke’s Aphasia (receptive): মস্তিষ্কের ওয়েরনিক এলাকায় ত্রুটির কারণে কোন ব্যাক্তির বোধগম্যতার (comprehention) ক্ষেত্রে মারাত্মক কোন সমস্যা হয় তবে সেটাকে wernicke’s aphasia বলে। এই বৈকল্যে যেসব সমস্যা হয় :-¬

  • তারা প্রায়ই এমন অনেক কথা বলে যার কোন অর্থ থাকে না।
  • এটাও হতে পারে যে তারা যে ভুল শব্দ কথার মধ্যে ব্যাবহার করবে, তাও তারা বুঝতে পারবে না। যেমন মাছের পরিবর্তে বলবে গাছ।
  • তারা অনেকগুলো অর্থহীন শব্দ সাজিয়ে বাক্যের মতো তৈরী করে যার কোন অর্থ থাকে না।

 Broca’s aphasia(expressive): যখন মানুষের মস্তিষ্কের বাম অংশের (left hemisphere)এর সামনের অংশে (ব্রোকা এরিয়া) কোন আঘাত লাগে বা ক্ষতি হয় তখন বিভিন্ন ধরনের ভাষাগত সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্কের এই অংশটি শব্দগুলোকে একত্রে সাজিয়ে বাক্য গঠন করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে আর এই অংশের ক্ষতির কারণে যে আ্যাফেজিয়া হয় তাকে broca’s aphasia বলে।¬

 Global aphasia: যদি স্ট্রোকের ফলে রোগীর বাম মস্তিষ্কের (left hemisphere) পিছনের এবং সামনের অংশের বর্ধিতাংশ আক্রান্ত হয় তবে এর ফলে Global Aphasia হয়। যেমন শব্দ এবং বাক্য বোঝার ও গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।¬

 Anomic Aphasia: Anomic আ্যাফেজিয়াকে dysnomia, nominal aphasia, বা amnesic aphasia ও বলা হয়। এটির কারণে কথার মধ্যে উপযুক্ত শব্দ ঠিকঠাক মতো ব্যবহারে কাঠিন্যতা দেখা দেয়।¬

 Primary Progressive Aphasia: এটি হলো স্নায়ুবিক একটি লক্ষণ এর কারণে আস্তে আস্তে মানুষের কথা বলা, বোঝা, পড়া ও লেখার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে বা হারিয়ে ফেলে।¬

আ্যাফেজিয়া নির্ণয়করণ

একজন speech and language pathologist বা SLP প্রথমে আপনার কথা বলার এবং ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা করে দেখবেন এবং তিনি আপনার সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবেন এবং আরো যা করতে পারেন সেগুলো হলো:-

  •  পরীক্ষা করে দেখবে যে আপনি কতো ভালো ভাবে শব্দ,প্রশ্ন, নির্দেশনা এবং গল্প বুঝতে পারেন।
  •  বিভিন্ন জিনিসের নাম জিজ্ঞেস করবে, ছবির বর্নণা দিতে বলতে পারে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে পারে।
  •  বিভিন্ন বর্ণ, শব্দ বা বাক্য লিখতে দিতে পারে, ছোট গল্প পড়তে দিবে এবং তার মধ্যে থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে বলবে।
  •  যখন আপনার বলতে অসুবিধা হবে তখন দেখবে কিভাবে আপনি অন্য উপায়ে আপনার বার্তাগুলো (massage) প্রদান করেন। এগুলোর মধ্যে থাকতে পারে pointing, gesture, drawing picture ইত্যাদি।

আ্যাফেজিয়ার রোগীদের সাথে কথা বলার সময় যে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা দরকার

এই পরামর্শগুলো আপনাকে আ্যাফেজিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তিদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে:-

  •  কথা শুরুর আগে রোগীর মনোযোগ আকর্ষন করা।
  •  কথা বলার সময় রোগীর সাথে eye contract করে কথা বলা,তাদের শরীরের অঙ্গ ভঙ্গির প্রতি খেয়াল রাখা।
  •  তাদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে কথা বলা।
  •  সাধারন আওয়াজে কথা বলা। বেশি জোরেও না আবার খুব আস্তেও না।
  •  কথা বলার সময় সহজ ও পরিচিত শব্দ ব্যাবহার করা।
  •  ছোট ছোট বাক্যে কথা বলা।
  •  ধীর গতিতে কথা বলা।
  •  রোগীদের কথা বলার জন্য সময় দেয়া।
  •  কথা বলার সময় drawing, gesture, writing এবং facial expression ব্যবহারের চেষ্টা করা।
  •  যখন তারা কথা বলতে পারবে না আটকে যাবে তখন তাদেরকে আঁকতে ,লিখতে বা নির্দেশ করতে বলা।
  •  yes, no question করা।
  •  কিছু কিছু সময় ভুল বলতে দেয়া কারণ তারা সবসময় সব কিছু ঠিকঠাক বলতে পারবে না।
  •  রোগীদের বারবার চেষ্টা করতে দেয়া।

আসুন আ্যাফেজিয়া সম্পর্কে আমরা নিজেরা জানি এবাং অন্যদের জানতে সহযোগিতা করি।

তথ্য সূত্রঃ-

1.ASHA.org/Aphasia
2.American stroke association.
3.MedicineNet.
4 Cleveland Clinic.
4.WebMD.
5.National Aphasia Association.

Leave a Comment

Skip to content