এপ্রাক্সিয়া কি?
এপ্রাক্সিয়া একটি স্নায়ুবিক অবস্থা যা সম্পর্কে এখনো ভালোভাবে জানা যায়নি। এপ্রাক্সিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তিরা তাদের মাংসপেশি স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও দেহের মোটর চলাচলে সমস্যা অনুভব করেন কিংবা অনেক সময় তারা মোটর চলাচল করতেই পারেন না। মৃদু এপরেক্সিয়াকে ডিপ্রাক্সিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এপ্রাক্সিয়া কয়েক ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো অরোফেসিয়াল এপ্রাক্সিয়া যারা অরোফেসিয়াল এপ্রাক্সিয়া আক্রান্ত তারা মুখের মাংসপেশির কিছু অংশ নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারেন না। উদাহরণস্বরুপ, তারা তাদের ঠোঁট নাড়ানো কিংবা চোখের পলক ফেলতে অক্ষম হতে পারে। এপ্রাক্সিয়ার আরেকটি ধরণ হলো এটি একজন ব্যাক্তির হাত-পা নাড়াচাড়া করার ব্যাপারে সমস্যা সৃষ্টি করা। স্পিচ এপ্রাক্সিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কথা বলার জন্য তাদের মুখ এবং জিহবা নাড়ানোয় সমস্যা অনুভব করে কিংবা অনেকে নাড়াতেই পারেননা। এটা এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে একজন মানুষ কথা বলতে চায় এবং তার কথা বলার এনাটমিক্যাল সক্ষমতা থাকার পরও কথা বলতে পারেন না।
বাকশক্তির এপ্রাক্সিয়া কি বিভিন্নরকম হয়?
বাকশক্তির এপ্রাক্সিয়ার দুইটা ধরন আছে-অর্জিত এপ্রাক্সিয়া এবং শিশুকালের এপ্রাক্সিয়া। অর্জিত এপ্রাক্সিয়া যেকোন বয়সের মানুষের হতে পারে। যদিও সাধারণত এটা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। এই সমস্যার কারণে মানুষ তার কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, যে ক্ষমতা তার একসময় ছিলো। শিশুকালের এপ্রাক্সিয়া একটি মোটর স্পীচ ডিজঅর্ডার। এই অবস্থাটি জন্ম থেকে শুরু হয় এবং এটি শিশুর শব্দ এবং ধ্বনি তৈরীর ক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটায়। বাকশক্তি এপ্রাক্সিয়া যুক্ত শিশুরা নিজে কথা বলার চেয়ে অন্যের কথা বুঝতে বেশি পারদর্শী হয়। শিশুকাল থেকে এপ্রাক্সিয়া আছে এমন বেশিরভাগ শিশুই পুরোপুরি ঠিক না হলেও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে বাচনশক্তিতে পরবর্তীতে ভালো উন্নতি হয়।
স্পিচ এপ্রক্সিয়া এবং এ্যফেসিয়ার(Aphasia) পার্থক্য কি?
মাঝে মাঝে এপ্রাক্সিয়া এবং এ্যফেসিয়ার মধ্যে গড়বড় তৈরি হতে পারে। এ্যফেসিয়া অপর একটি যোগাযোগ বৈকল্য। এ্যফেসিয়া মস্তিষ্কের কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট এলাকার গঠনগত অথবা শারীরতাত্ত্বিক বিকলতার জন্য সৃষ্ট একজন ব্যাক্তির কথ বোঝার ক্ষমতা অথবা কথাবলা ক্ষমতার সমস্যাকে নির্দেশ করে। এটি একজন ব্যাক্তির পড়া, লেখা কিংবা কথা বলার ব্যাপারটিকে আরো কঠিন করে দিতে পারে। কিন্তু এপ্রক্সিয়া ভাষাগত বোধশক্তির কোন সমস্যা নয়। বরং এপ্রাক্সিয়া বাচনের জন্য ব্যাক্তির যেসব পেশীর নাড়াচাড়া করার দরকার, সেসব পেশীর নাড়াচাড়ায় যে সমস্যা হয় তাকে নির্দেশ করে। ব্যাক্তির কথা বলায় প্রয়োজনীয় পেশীতে দূর্বলতা না থাকলেও এই সমস্যার উদ্ভব ঘটে। এটি স্নায়ুকলার নেটওয়ার্ক বিষয়ক বৈকল্য।
স্পিচ এপ্রাক্সিয়ার লক্ষ্মণগুলো কি?
বাচন সম্পর্কিত বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে যা এপ্রাক্সিয়া আছে এমন মানুষের মাঝে দেখা যায় যেমন-
- একটা অক্ষরের পর কোন অক্ষর ব্যবহার করা যাবে (Syllabic composition) সেটা বুঝতে
কস্ট হওয়া এবং নির্দিষ্ট নিয়মে অক্ষর ব্যবহার করে শব্দ তৈরীতে অক্ষমতা। - শিশুকালে আধঃবোল (babbling) কম হওয়া।
- বড় বা কঠিন শব্দ বলতে সমস্যা হওয়া।
- একই শব্দ উচ্চারণে অনেকবার চেষ্টা করা।
- কথাবার্তায় অসংগতি, যেমন যেকোনো একটি সময়ে কোনো শব্দ বলতে সক্ষম হলেও
পরবর্তীতে তা বলতে না পারা। - কিছু কিছু শব্দ ভুলভাবে উচ্চারণ করা এবং কিছু শব্দ উচ্চারণের সময় মানসিক চাপ অনুভব
করা। - যোগাযোগের অবাচনিক পদ্ধতি যেমন হাত নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, স্পর্শ করে যোগাযোগ করার
আধিক্য । - স্বরবর্ন ঠিকস্থানে উচ্চারণ না করা।
- বাক্যের শুরুতে এবং শেষে ব্যঞ্জনবর্ন বাদ দেওয়া।
- শব্দ তৈরী কষ্টসাধ্য হওয়া, শব্দ তৈরীর জন্য হাঁতরানো।
শিশুদের বাকশক্তির এপরেক্সিয়া কদাচিৎ একক হয় বরং এটা প্রায়ই অন্যান্য ভাষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতির অনুষঙ্গী হিসেবে থাকে,যার কারণে- সীমিত শব্দতালিকা ব্যাকরণঘটিত সমস্যা সমন্বয় এবং ফাইন মোটর দক্ষতায় সমস্যা চিবানো ও গলাধঃকরনে সমস্যা অবিচক্ষণতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
বাকশক্তির এপ্রাক্সিয়া কি কারণে হতে পারে?
স্পিচ এপ্রাক্সিয়ার মূল কারণ কি তা নির্দিষ্ট করে বলা এখনো সম্ভব না। তবে এ সম্পর্কিত বেশ কিছু গবেষণা তথ্য আছে যেমন অর্জিত এপ্রাক্সিয়া মস্তিষ্কের যেসব অংশ কথা বলার সক্ষমতা সৃষ্টি করে, সেসব অংশে ক্ষতির কারণে হয়। কিছু বিজ্ঞানিদের ধারণা, মস্তিষ্ক এবং যেসব পেশী কথা বলার সাথে সম্পর্কিত এদের মধ্যে সংকেতের আদান প্রদান ঘটিত সমস্যার কারণে এটি হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় মস্তিষ্কের যে সমস্যার কারণে এপরেক্সিয়া হয় তা বের করার চেষ্টা চলছে। কিছু গবেষণা এপ্রাক্সিয়ার উপর জিনের ভুমিকা বের করার চেষ্টা করছে। কিছু গবেষণা এই সমস্যার জন্য মস্তিষ্কের ঠিক কোন অংশটি দায়ী তা বের করার চেষ্টা করছে।
স্পিচ এপ্রাক্সিয়া নির্ণয় করার কোনো পরীক্ষা আছে কি?
শিশুকালের এপ্রাক্সিয়া নির্ণয়ের নির্দিষ্ট কোনো একটি পরীক্ষা নেই। এটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা কঠিন কেননা বাচনচিকিৎসকদের মাঝে (speech and language pathologist) এই সমস্যাটা কোন লক্ষণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যায় এ নিয়ে মতনৈক্য রয়েছে। তবুও অনেক বিশেষজ্ঞগণ এপ্রাক্সিয়ার বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ খোঁজার চেষ্টা করেন। তারা একজন রোগীর কিছু শব্দ পুনরাবৃত্তি (repetition) করা দিয়ে বিচার করেন, কিংবা কোনো রোগী একটা তালিকার শব্দ বলতে পারছে কি না, যেখানে তালিকার নিচের দিকে শব্দ গুলো কঠিন থেকে কঠিনতম হতে থাকে সেটা তারা লক্ষ্য করেন। যেমনঃ খেলা, ক্রীয়নশীল, খেলাচ্ছলে অথবা ক্ষুধা, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধাতুর, ক্ষুধামুক্ত।
একজন বাচনচিকিৎসক একটি শিশুর সাথে আলোচনা করে দেখতে পারেন, সে কোন কোন ধ্বনি,শব্দ উচ্চারণ করতে এবং বুঝতে পারেনা। প্যাথলজিস্ট শিশুটির মুখ, জিহবা, মুখগহ্বর পরীক্ষা করে দেখবেন তার কোনো গঠনগত ত্রুটির কারণে এপ্রাক্সিয়ার লক্ষন দেখা যাচ্ছে কি না। এপরেক্সিয়া পরীক্ষার সময় বিশেষজ্ঞগণ অন্যান্য লক্ষণ ও পরীক্ষা করবেন যেমন, তারা দূর্বলতা এবং ভাষাগত বোধশক্তি খেয়াল করবেন। এই দুইটি লক্ষণই অন্যান্য সমস্যার নির্দেশক এবং এইগুলো খুঁজে পেলে শিশুর এপ্রাক্সিয়ার ধারণা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। যেসব ব্যাক্তির সম্ভাব্য অর্জিত এপ্রাক্সিয়া আছে, মস্তিষ্কের এমআরআই এর মাধ্যমে এটি কোন জায়গায় আছে এবং কতটুকু ছড়িয়েছে তা বোঝা যেতে পারে। সাধারণত দুই বছরের আগে শিশুর বাকশক্তির এপ্রাক্সিয়ার পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। কারণ এই সময়ের আগে এপরেক্সিয়া পরীক্ষার যে ধাপগুলো তা শিশু বুঝতে পারে না।
বাকশক্তির এপ্রাক্সিয়ার কি কোনো চিকিৎসা আছে?
অর্জিত এপ্রাক্সিয়ার কিছু ক্ষেত্রে এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাধান হয়ে যায়। তবে শিশুকালের এপ্রাক্সিয়া চিকিৎসা ছাড়া যায় না। এপ্রাক্সিয়ার বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে। ব্যাক্তিবিশেষে এই চিকিৎসার কার্যকারিতা নির্ভর করে। সবচেয়ে ভালো ফলাফলের জন্য ব্যাক্তির প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসা দিলে এটি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বেশিরভাগ এপ্রাক্সিয়া আক্রান্ত শিশুই বাচন এবং ভাষার প্যাথলজিস্ট এর কাছ হতে সপ্তাহে ৩-৫ বার থেরাপী নিয়ে উপকৃত হয়। তাদের দক্ষতার বিকাশের জন্য বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের সাথেও অনুশীলন করার প্রয়োজন হতে পারে।
শিশুকালের এপ্রাক্সিয়ার ভালো করার জন্য যেসব চর্চা করা যায় তা হলো- শব্দের গঠন এবং উচ্চারণ বার বার অনুশীলন করা, যুক্তশব্দের অনুশীলন করা, তাল এবং সুর নিয়ে কাজ করা, বিভিন্ন কাজ একসাথে করা, যেমন, শব্দ তৈরীর সময় আয়না দেখা কিংবা কথা বলার সময় মুখমণ্ডল স্পর্শ করা।
অনেক থেরাপিস্ট মনে করেন যাদের বুঝতে অসুবিধা হয় তাদের জন্য সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা উপকার করতে পারে। তারা সুপারিশ করেছেন যে শিশুদের সাংকেতিক ভাবে যে কথা বলা হয় তারা তা মুখে বলার চেষ্টা করে।
যেসব ব্যাক্তির অনেক জটিল অর্জিত এপ্রাক্সিয়া আছে তাদের ক্ষেত্রেও সংকেত ভাষা (Sign Language) সাহায্য করতে পারে। অথবা তারা শব্দ এবং বাক্য তৈরীর জন্য সাহায্যকারী যন্ত্র যেমন কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় শিশুদের এপ্রাক্সিয়ার উন্নতিতে বিভিন্ন চিকিৎসার পারস্পরিক সম্পর্ক দেখা গেছে। কিন্তু কোন চিকিৎসাটি শিশুর এপ্রাক্সিয়ায় অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখে তা নিয়ে চিকিৎসকদের মতবিরোধ আছে।
[এই লেখাটি WebMD নামক মেডিকেল রেফারেন্স ওয়েবসাইট থেকে শুধুমাত্র জনসচেতনতা এবংএকাডেমিক ডিসকোর্স সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অনুবাদকৃত]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী। নিজেকে উদ্যমী, সাহসী, স্বাধীনচেতা এবং সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি চেষ্টা করছি মানুষকে সচেতন করার।সমাজের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ড এবেইলজমের বিপরীতে তথাকথিত অক্ষম মানুষদের সক্ষমতার পরিচয় সকলের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবী এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।