গনিত শিখণ বৈকল্য ডিসক্যালকুলিয়া

কোনো একদিন কৃষ্ণচূড়া ফোটা রক্তিম বিকেলে আপনি ধূলোওড়া পথ ধরে হেটে চলছেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো- এখন কয়টা বাজে? আপনি আপনার হাতের এনালগ ঘড়ির দিকে তাকালেন, পরক্ষণেই আবার মোবাইলের ডিজিটাল ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করলেন। আপনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সময় বলতে কিন্ত পারছেন না। ফলাফল আপনি ঘেমেনেয়ে একাকার, দুহাতে মাথার ছেড়া চুল।

ঝালমুড়ি- মামার কাছ থেকে মুড়ি নিয়ে ছিলেন ৩ প্যাকেট। প্রতি প্যাকেটের মূল্য ১০ টাকা হলে, আপনি ৫০ টাকার নোট দিলে, মামা কত ফেরত দিবেন- তা আপনার মাথায় ধরছে না।

আপনি রাস্তায় বের হলেন ঘুরতে হঠাৎ মনে হলো আপনার মোবাইল হারিয়ে ফেলেছেন। অন্যের ফোন থেকে ফোন দিবেন বলে অনুরোধ করে ফোন হাতে নিয়েছেন – কিন্তু আপনি আপনার ফোন নাম্বার ভুলে গেছেন।

ত্রিশতলা ব্যাংকের লিফটে উঠে মনে করতে পারছেন না কোন তলায় আপনার ‌যাবার কথা- তালগোল পাকিয়ে হতাশা ভর করছে আপনার ওপরে।

এসব লজ্জাজনক এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কারো জীবনে হয়তো দু-একটি ঘটতে পারে কিন্তু পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩-৬ শতাংশ এই রকম গনিত এবং গননা বিষয়ক বৈকল্যে ভুগছেন বলে গবেষকরা জরিপ করে দেখেছেন ^১। কল্পনা করুন এমন একটি জীবন যেখানে সংখ্যা কিংবা সংখ্যাজ্ঞানের কোনো অস্তিত্ব নেই- আপনি বুঝতে পারেন না সময়; এটি কি কিংবা কেমন, কি সময়ের প্রবহধারা। আপনার জানা নেই সাংখ্যিক কোনো মান, বড়- ছোট এবং কম-বেশি সব আপনার কাছে একই লাগে। এমন জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই যান ডিসক্যালকুলিক জনগোষ্ঠী।

ডিসক্যালকুলিয়া কি?

ডিসক্যালকুলিয়া শব্দটির বুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এর প্রথম অংশ Dys একটি গ্রিক উপসর্গ যার অর্থ দূর্বল,মন্দ, খারাপ অথবা নেতিবাচক কিছু এবং শেষাংশ Calculia একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ গননা করা। সুতরাং Dyscalculia কে আভিধানিক অর্থে “গননায় দূর্বল” অথবা “গনিতে খারাপ” বলা যেতে পারে। ডিসক্যালকুলিয়া: অঙ্ক শিখনে প্রতিবন্ধকতা।  মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনো ত্রুটির কারণে গনিত অনুধাবন এবং গনিত শিখন বিকারকে ডিসক্যালকুলিয়া বলে। ডিসক্যালকুলিয়াকে আমেরিকান সাইকোলজি এসোসিয়েশন তাদের DSM-4 এ গাণিতিক বৈকল্য (Mathematical Disorder) এবং গণিত শিখন প্রতিবন্ধকতা (Mathematics learning disability) বলে উল্লেখ করেছে। DSM-5 এর সংজ্ঞানুসারে সংখ্যা জ্ঞান, পাটিগনিতিক বিষয়সমূহ আয়ত্বকরন, সঠিক, সাবলীল, নির্ভুল গানিতিক অপারেশন এবং সঠিক গানিতিক যুক্তি অনুধাবনের বিচ্যুতিকে ডিসক্যালকুলিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গানিতিক প্রক্রিয়া, গানিতিক প্রতীক, গানিত এবং যৌক্তিক ফাংশন সম্পাদনে সম্পূর্ণ বিকার অথবা ধীরগতিতে সম্পন্ন করার নামই ডিসক্যালকুলিয়া। এ বৈকল্যের বিভিন্ন ধাপ আছে যেমন কেউ হয়তো সংখ্যা কিংবা গণিতের মূল ধারণাকে মস্তিষ্কে অনুধাবন করতে পারেনা, আবার কেউ মূল ধারণা বুঝতে পারলেও সংখ্যা এবং প্রতীকসমূহ বুঝতে পারছন না, আবার কেউ সংখ্যা এবং প্রতীক ব্যবহার করে অর্থপূর্ণ গাণিতিক সমীকরণ গঠন এবং লজিক্যাল ফাংশন সম্পাদনে দূর্বলতা প্রকাশ, আবার কোনো কোনো ডিসক্যালকুলিক প্রতীক-সংখ্যা বুঝা,মূল ধারনা অনুধাবন, যৌক্তিক এবং গানিতিক অপারেশন সম্পন্ন করতে পারলেও একটি সাধারণ নিয়মকে পরে সাধারণীকরন করে ব্যবহার করতে পারেন না যেমন ০ এর সাথে ৫ গুন করলে শূন্য হয়- এটা হয়তো তিনি বুঝতে পারলেন এবং তাকে বলে দেয়া হলো এভাবেই ০  সাথে যেকোনো সংখ্যার গুণফল ০ হবে। কিন্তু পলে তাকে ১০০ এর সাথে শূন্য গুন করতে বললে ঐ ডিসক্যালকুলিক হয়তো বিচলিত হয়ে পরবেন। এই বৈকল্যে আক্রান্ত মানুষদের যোগ-বিয়োগের মতো বেসিক এবং সহজ গানিতিক ক্রিয়াও ডিসক্যালকুলিকদের জন্য অসম্ভব হয়ে থাকে। অধ্যাপক বাটারওয়ার্থ বলেন- এই ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করতে প্রায়ই হোঁচট খায়। খুচরা পয়সা গুনতে ভুল করে। ছোট-বড় সংখ্যা চিনতে ভুল করে। যেমন, ৩, ৮ ও ৯ অঙ্কগুলো ক্রমানুযায়ী সাজাতে বললে ভুল করে বসে। আবার যদি ৭০-এর পর ১০ ব্যবধানে সংখ্যা গুনতে বলা হয়, তাহলে তারা গুনবে এভাবে—৭০, ৮০, ৯০, ১০০, ২০০, ৩০০।  

ডিসক্যালকুলিয়ার ইতিহাস

ডিসক্যালকুলিয়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে ১৯৪০ সালে এর আলোচনার সূত্রপাত দেখা যায়। তখন ড. জোসেফ গার্টসম্যান একধরনের স্নায়ুবিক বৈকল্যের কথা বলেন যেখানে মস্তিষ্কের কোনো অংশের ত্রুটির জন্য মানুষের চারধরনের বোধজ্ঞানিক দক্ষতা (cognitive abilities) বিকারগ্রস্ত হয়ঃ

  • আ্যাগ্রাফিয়া বা ডিসগ্রাফিয়া: নিজের চিন্তা বা মনের ভাবকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে না পারা। 
  • আ্যাক্যালকুলিয়া: সাধারণ গানিতিক অপারেশন সম্পাদনে ব্যার্থতা যাকে নাম দেয়া হয়েছিল। 
  • ফিংগার আ্যাগনোশিয়া: নিজের এবং অপরের হাতের আঙুলের মাঝে পার্থক্য না করতে পারা।
  • ল্যাটেরাল ডিরেকশণঃ নিজের শরীরের বাম এবং ডান পাশের মধ্যে পার্থক্য চিন্হিত করতে না পারা।

এই চারধরনের বিচ্যুতি একত্রে গার্টসম্যান সিন্ড্রোম নামে পরিচিত। প্রথমত ডিসক্যালকুলিয়াকে গার্টসম্যান সিন্ড্রোমের একটি প্রকার হিসেবে বিবেচনা করা হতো‌। এরপরে কেউ কেউ ডিসক্যালকুলিয়াকে পঠন বৈকল্য ডিসল্যাক্সিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু দেখা যায় ডিসল্যাক্সিয়া একটি পঠন বৈকল্য এবং শুধুই পাঠ সম্পর্কিত বিকার হলেও ডিসক্যালকুলিয়া কেবলমাত্র পঠন এবং শিখন বৈকল্যই নয় বরং এখানে অনুধাবন এবং একই যুক্তির ভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যবহারের সাধারনীকরন উপস্থিত। লাদিস্লাভ কস্ক, একজন চেকোস্লোভাকিয়ান স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রমাণ করেন এটি আসলে একটি ভিন্নরকমের বৈকল্য। তিনি প্রথমবারের মতো ডেভেলপমেন্টাল ডিসক্যালকুলিয়ার ধারনা দেন এবং ডিসক্যালকুলিকদের বিকারের ধরনানুসারে ডিসক্যালকুলিয়াকে ৬ ভাগে ভাগ করেন:-

  1. বাচনিক ডিসক্যালকুলিয়া(Verbal Dyscalculia): Verbal শব্দটির অর্থ হলো “Of word”। ভার্বাল ডিসক্যালকুলিয়া বলতে বোঝানো হয় গানিতিক ধারনা সমূহ বাচনিকভাবে[শাব্দিক মাধ্যমে, ভাষার মাধ্যমে] উপস্থাপন এবং অনুধাবনের অসুবিধা। এই বৈকল্যে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা লিখতে কিংবা পড়তে সমস্যা হয়না কিন্তু যখন শাব্দিক মাধ্যমে তাদের সামনে বলা হয় তখন তা অনুধাবন করতে পারেনা। উদাহরণস্বরূপ একজন ডিসক্যালকুলিক তিনি ১ বলতে কি বোঝায় তা বুঝেন, ১ দেখলে বুঝেন, ১ লিখতে পারেন কিন্তু যখন বলা হয় অথবা লেখা হয় ‘এক’ তখন তিনি অনুধাবন এবং এক বলতে কি বোঝায় তা শনাক্ত করতে পারেনা। 
  2. প্রাক্টোগনস্টিক ডিসক্যালকুলিয়া: এই ধরনের ডিসক্যালুলিকরা গানিতিক ধারনা, প্রতিক এবং অপারেশন বুঝতে পারলেও তা বাস্তবতার সাথে সংযুক্ত করতে পারেন না যেমন ১,৩ বলতে যে ম্যাথমেটিকাল সেন্স বুঝায় তা বুঝেন কিন্তু যখন বলা হয় ১ টি মেয়ে, ৩ টি ছেলে বলতে কি বোঝায় তা বুঝতে অসুবিধা হয়। 
  3. ল্যেক্সিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া: এই ধরনের ডিসক্যালুলিকদের গানিতিক প্রতিক, সংখ্যা , অপারেশন, সমীকরণ পাঠ করতে অক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়। তারা বুঝতে পারেন কিন্তু বলতে পারেন না। যেমন ৩ + ২ = ৫  এটা বুঝতে পারেন কিন্তু বলতে পারেন না যে তিন যোগ দুই সমান পাঁচ। 
  4. গ্রাফিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া: গাণিতিক প্রতিক,ধারনা,সংখ্যাসমূহ, অপারেশন সব বুঝতে পারলেও যখন তা লিখিত ভাষায় প্রকাশ করতে পারেনা অথবা ভুলভাবে করে তখন ঐ ডিসক্যালকুলিয়াকে গ্রাফিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া বলে। উদাহরণস্বরূপ একজন বুঝেন তিন আর দুই যোগ করলে পাঁচ হয় অথচ লিখতে গেলে এটা আর লিখতে পারেন না অথবা ভুল লেখেন যেমন ৩%২= ৫ এরকম লিখে ফেলেন। 
  5. ইডিওগনোস্টিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া: এই ধরনের ডিসক্যালকুলিকরা বিভিন্ন সংখ্যা, প্রতীক লিখতে ও বুঝতে পারলেও গড়, শতকরা, লগারিদমের, সূচক, সুপারস্ক্রিপ্ট,সাবস্ক্রিপ্ট সংখ্যা বুঝতে পারেন না। এদের প্রাথমিক অসুবিধাটা হয় গানিতিক যুক্তিসমূহ বুঝতে এবং তা পূনর্ব্যবহার করতে। 
  6. অপারেশনাল ডিসক্যালকুলিয়া: এই ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের গানিতিক অপারেশন,ইকুয়েশন সম্পাদনে অসুবিধা হয়। ডিসক্যালকুলিক হয়তো বুঝতে পারেন সম্পূর্ণ কনসেপ্ট কিন্তু এটার গানিতিক কিংবা ও সামীকরনিক প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন।

 

ড. কস্কের পর আলফ্রেড আরদিলা, ব্রায়ান বাটারওর্থ আরো অনেকেই ডিসক্যালকুলিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন যেমন নিউম্যান ১৯৯৮ সালে ডিসক্যালকুলিয়াকে কোয়ালিটেটিভ, কোয়ান্টিটেটিভ, ইন্টারমিডিয়েট এই তিন ভাগে বিভক্ত করেন। আবার ২০০০ সালে ডেভিড গিয়ারী ও তার সহকর্মীরা ডিসক্যালকুলিয়ার পরিবর্তে  “mathematical disabilities” শব্দটি ব্যবহার করে ডিসক্যালকুলিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করেন –

  • Procedural Dyscalculia: গননা করতে অসুবিধা, গানিতিক অপারেশন এর কোন ধাপের পরে কোন ধাপ হবে তা নিয়ে দ্বিধায় থাকা এবং Working Memory তে কাজের ত্রুটি এই ডিসক্যালুয়ার প্রকাশ।
  • Semantic Memory Dyscalculia: সাধারণ গানিতিক অপারেশন বুঝতে না পারা, সংখ্যা-প্রতিক মনে রাখতে না পারা এই উপশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
  • Visual-spatial  Dyscalculia: গানটিক ধারনার লৈখিক অথবা বাস্তবিক প্রকাশকে দৃষ্টির মাধ্যমে চিন্হিতকরন, এদের পারষ্পরিক পার্থক্যকরন[ছোট,বড়] এবং স্থানিক বিন্যাস যেমন কার জ্যামিতিক আকৃতি কেমন, কে উপরে অথবা নিচে এসব সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ Visual-spatial Dyscalculia নামে পরিচিত।

২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ডিসক্যালকুলিয়া নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তার প্রায় সবই ডিহক্যালকুলিয়ার সাথে মস্তিষ্কের কোন অংশের সংযুক্তি রয়েছে তা নিয়ে। অবশ্য ডিসক্যালকুলিকদের পাঠদান পদ্ধতি, তাদের জীবনধারা এবং ডিসক্যালকুলিয়া শনাক্তকরনের টুল নিয়েও কিছু গবেষণা হয়েছে।

 

আপনি কিভাবে বুঝবেন যে আপনার পরিচিত কারো ডিসক্যালকুলিয়া আছে কিনা? 

ডিসক্যালকুলিয়া একটি শিখণ বৈকল্য সুতরাং এর সতর্কতামূলক লক্ষণসমূহ শিখন সম্পর্কিত হবে যেমন:-

  • গননা শিখনে প্রতিবন্ধকতা।
  • সংখ্যা অনুধাবন এবং আয়ত্বকরনে দূর্বলতা।
  • গানিতিক ধারনার সাথে বাস্তবতার সাদৃশ্যকরণে কাঠিন্য।
  • যৌক্তিকতার ক্রমানুসারে কোনো কিছু সাজানোতে অক্ষমতা।
  • সহজ এবং মৌলিক গানিতিক অপারেশন – যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে সমস্যা।
  • প্রবলেম সলভিং দক্ষতা কম থাকা।
  • গানিতিক শব্দকোষ ছোট হওয়া।
  • কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা।
  • ছোট বড় দুটি বস্তুর মধ্যে কোনটি ছোট কিংবা বড় বুঝতে না পারা।
  • প্যাটার্ন বা স্ট্রাটেজি করে কোনো সমস্যার সমাধান করতে না পারা।
  • সময় এবং দিক নির্দেশনে দূর্বলতা।

বিশেষজ্ঞরা ডিসক্যালকুলিয়া নির্নয়ের জন্য  বিশেষজ্ঞরা তিনটি ধাপ  অনুসরন করেন। ধাপসমূহ হলো:-

  1. নিবিড় সাক্ষাৎকার: এই ধাপে পারিবারিক ইতিহাস, ব্যাক্তি কোন কোন জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং ডিসক্যালকুলিয়ার সাধারণ লক্ষণসমূহ তার মধ্যে আছে কিনা এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এই সাক্ষাৎকার এর সময় সাধারণত আক্রান্ত ব্যাক্তির পাশাপাশি তার শিক্ষক, পিতা-মাতা, অভিভাবক বা এরকম কেউ উপস্থিত থাকেন। 
  2. ডিসক্যালকুলিয়া স্ক্রিনিং: ডিসক্যালকুলিয়া নির্নয়ের জন্য প্রফেশনাল ডিসক্যালকুলিয়া বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিনিং টেস্ট করেন যার মাধ্যমে তারা সংখ্যা-ধারনা, সংখ্যা-পার্থক্য, গনিতের গ্রাফিক প্রকাশ, প্রতিক-সাংকেতিক মান, সংখ্যা এবং আকৃতির স্থানীয় মান, যৌক্তিক অপারেশন এবং সমীকরণ দক্ষতা পরিমাপ করার চেষ্টা করেন। 

  3. গানিতিক দক্ষতা পরিমাপ: বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠিত এবং গৃহীত গানিতিক দক্ষতা পরিমাপক স্কেল (যেমন WIAT-2, CAB-DC) দিয়ে গানিতিক দক্ষতা পরিমাপ করা হয়।

ডিসক্যালকুলিয়া শনাক্তকরণে এছাড়াও বেশ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা হয় যেমন সজ্জা বিন্যাস (Sequencing), সোজা এবং আড়াআড়ি দিকনির্দেশনা, প‍্যাটার্ন বুঝতে পারা, দৃষ্টিসংযোগ,সামস্টিকরন, পার্থক্যকরন ইত্যাদি দক্ষতা কতটুকু আছে।

 

ডিসক্যালকুলিয়া মস্তিষ্কের যেসব স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়

এ পর্যন্ত গবেষণার তথ্যমতে মানুষের মস্তিষ্কের প্যারাইটাল অঞ্চলের ইন্টারপ্যারাইটাল সালকাসের কোনো গাঠনিক অথবা কার্যিক ত্রুটিই ডিসক্যালকুলিয়ার কারণ। ডিসক্যালকুলিকরা সাধারনত বেশ কয়েকধরনের স্বাভাবিক স্নায়ুবিক কর্মে অক্ষমতা অথবা দূর্বলতা প্রকাশ করে। যেমন:-

  • মনোসংযোগ: মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কজনিত সমস্যা থাকার দরুন ডিসক্যালকুলিকদের প্রায়ই মনোসংযোগে অসুবিধা হয়ে থাকে। সাধারনত তারা খন্ডিত মনোযোগ (Divided attention) প্রদর্শন করে যা তাদের স্বাভাবিক ধাপে ধাপে কোনো অংঙ্ক সমাধান করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রকাশ পায়। 
  • কার্যকরী স্মৃতি: মনোবিজ্ঞানের আলোচনা অনুযায়ী মানুষের একটি ক্ষণস্থায়ী কার্যকরী স্মৃতি রয়েছে যা কোনো কাজের সময় কাজের ধাপ, পূর্বের ধাপের সাথে পরের ধাপের সংযোগ করতে সহায়তা করে থাকে। যেমন আপনি কারো সাথে কথা বলছেন তখন কথার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো আপনার মনে থাকে তাই আপনি কথা চালিয়ে যেতে পারেন, অথচ আপনাকে পরে ঐ কথাগুলো যা আপনি তখন মনে রেখে আপনার কথোপকথন চালিয়ে গিয়েছিলেন তার খুব কমই মনে করতে পারেন। এভাবেই আপনি যখন কোনো গানিতিক সমস্যা সমাধান করেন তখন একটি কার্যকরী স্মৃতির প্রয়োজন হয় আর ডিসক্যিলকুলিকদের কার্যকরী স্মৃতিতে বিচ্যুতি থাকে

  • শর্ট টার্ম মেমরি: এটি কার্যকরী স্মৃতির থেকে একটু বেশি সময় ধরে স্মৃতি ধরে রাখে যা আমাদের বড় একটি অথবা অনেকগুলো ধাপানুযায়ী কিছু সমাধান করতে সাহায্য করে। যেমন আপনি পরীক্ষার সময়ে অনেকগুলো সমস্যার একটির পর আরেকটি সমাধান করে থাকেন। ডিসক্যালকুলিকদের শর্ট টার্ম মেমরি এবিলিটি কম থাকে। 
  • নামকরন: ডিসক্যালকুলিকদের কোনো কিছুকে নাম দিতে অথবা নাম মনে রাখতে সংগ্রাম করতে হয়। তারা বুঝতে পারেন, মস্তিষ্কে আবছা আবছা ধারনাও থাকে অথচ নাম মনে করতে পারেন না। 
  • পরিকল্পনা: ডিসক্যালকুলিকদের ক্রম,ধাপ ইত্যাদি দক্ষতা কম থাকার কারণে তাদের জন্য গুছিয়ে পরিকল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।

ডিসক্যালকুলিয়ার লক্ষণ

Dyslexia.com.au এর মতে বয়সের সাথে সাথে ডিসক্যালকুলিয়ার লক্ষণগুলোও ভিন্ন হয়ে প্রকাশ পায়।

স্কুলে যাবার পূর্বে:

  • গননা করতে না পারা
  • দ্রুত গননা করা এবং ভুল উত্তর দেয়া
  • সংখ্যার সাংকেতিক চিন্হসমূহ বুঝতে না পারা। ২ এবং z,s অথবা এরকম আকৃতিগত নিকটসাদৃশ্য প্রতিকের মধ্যে প্যাচ লাগানো।
  • সংখ্যাকে বাস্তবতার সাথে মিলাতে না পারা‌। যেমন ৫ টি কলা মানে যে কয়টি কলা বা বুঝতে না পারা।
  • সজ্জাগত(pattern) পার্থক্য যেমন বড় ছোট বেশি কম পার্থক্য না করতে পারা।
  • সংখ্যাভিত্তিক খেলা যেমন লুডু,দাবা ইত্যাদি খেলতে না পারা।
  • কোনো কাগজে অথবা স্ক্রিনে মূদ্রিত সংখ্যা চিনতে অসুবিধা হওয়া।
  • নিজের বয়সের অন্যান্য শিশুদের তুলনায় সংখ্যা, প্রতীক ইত্যাদি আয়ত্বকরন করনে পিছিয়ে থাকা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে:

  • তখনো গননা এবং সংখ্যা চিনতে না পারা।
  • সাধারন যোগ বিয়োগ বুঝতে না পারা।
  • বেসিক অপারেশন যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করতে না পারা।
  • সবসময় গননা করতে হাতের আঙুল ব্যবহার করা।
  • বড়-ছোট, বেশি-কম, আগে-পরে সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারা।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে:

  • ছোটোখাটো গনিত দিয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান করতে না।
  • পরিমাপ করতে না পারা
  • দিক নির্দেশনে দূর্বলতা।
  • গ্রাফ-চার্ট বুঝতে না পারা
  • সময় বলতে অসুবিধা হওয়া।
  • ছোটো এবং সহজ অংঙ্ক মুখে মুখে  করতে না পারা।
  • বিভিন্ন সাংখ্যিক মান যেমন বাড়ি নং, রোল নম্বর, মোবাইল নাম্বার মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া।

প্রাপ্তবয়স্ককালে

  • দরদাম করে ঠিকঠাকভাবে যোগ বিয়োগ করে কেনাকাটা করতে না পারা।
  • একটু উঁচু পর্যায়ের গাণিতিক সমস্যাসমূহ সমাধান করতে না পারা।
  • টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে না পারা।
  • স্থান, সময় এবং দূরত্বের সংজ্ঞা বুঝতে না পারা।
  • একই সমস্যার বিভিন্ন সমাধান বের করতে না পারা

 

ডিসক্যালকুলিয়া হবার কারণ

ঠিক কী কী কারণে ডিসক্যালকুলিয়া হয় তা স্পস্টত এখনো গবেষকদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এখন পর্যন্ত নির্ধারিত সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • মস্তিষ্কের গঠনগত ত্রুটি: টার্নার সিন্ড্রোম,ফোয়েটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোম অথবা কোনো কারণে ছোট ওজনের মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করা। মস্তিষ্কে গ্রে ম্যাটার এর পরিমাণ কম হওয়া বিশেষ করে ইন্টার প্যারাইটাল এলাকায় গ্রে ম্যাটার এর কমতি ডিসক্যালকুলিকদের মধ্যে দেখা যায়। 
  • জিনগত ত্রুটি: বিভিন্ন জিনগত সমস্যা যেমন টার্নার সিন্ড্রোম, ফ্রাগাইল X সিন্ড্রোম, ভেলিডোকার্ডিওফেসিয়াল সিন্ড্রোম, উইলিয়াম সিন্ড্রোমের কারনে ডিসক্যালকুলিয়া হতে পারে। আবার কিছু কিছু গবেষণা এটাও বলে যে ডিহক্যালকুলিয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট মিউট্যান্ট জিনও থাকতে পারে। 
  • গর্ভকালীন ত্রুটি: গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল পান এবং অপরিনত বাচ্চাদের ডিসক্যিলকুলিয়ায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি। 
  • অন্যান্য রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: অন্যান্য শিখন বৈকল্য ডিসল্যাক্সিয়া, ডিপ্রাক্সিয়া, ডিসগ্রাফিয়া এবং ADHD এর সাথে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ডিসক্যিলকুলিয়ার লক্ষণ কারো মধ্যে প্রকাশ পেতে পারে ‌।

 

ডিসক্যালকুলিয়া হলে করনীয়

কারো মধ্যে ডিসক্যালকুলিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে তার উচিত এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কারো মাধ্যমে তার ডিসক্যালকুলিয়া আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া। ডিসক্যালকুলিয়ার যেহেতু কোনো স্বীকৃত ঔষধ নেই তাই বিভিন্ন রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়াই এর সমাধান।

বাসায়:

  • একসাথে ঘরের কাজ করা যেমন রান্না করা। রান্না করতে গেলে কতটি পেঁয়াজ কুচি করতে হবে, কতগুলো মরিচ লাগবে, ঠিক কতক্ষণ চুলোয় রাখতে হবে এসব বাস্তব সমস্যার মাধ্যমে গানিতিক বোধ তৈরি হবে।
  • একসাথে বাজার করতে যাওয়া। বাজারে গেলে দরদাম দেখলে, কেনা বেচার অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে সংখ্যাবোধ তৈরি করে।
  • সংখ্যাভিত্তিক খেলা খেলতে উৎসাহিত করা যেমন লুডু,দাবা,সুদোকু।
  • ঘড়ি নিয়ে খেলতে উৎসাহিত করা।
  • দিক নির্দেশ বিষয়ক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এ অংশগ্রহণ করা যেমন রাইডিং গেম এবং ফাইটিং গেম।

স্কুলে:

  • অংক বুঝা এবং সমাধানের জন্য একটু বেশি সময় দেয়া।
  • ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া।
  • টাচ,অডিও-ভিজ্যুয়াল শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষা প্রদান করা।

সর্বোপরি সামাজিকভাবে ডিসক্যালকুলিয়া সম্পর্কে সচেতনতা এবং ডিসক্যালকুলিকদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়াই ডিসক্যালকুলিয়ার সমাধান।

অনেকের মতে আলবার্ট আইনস্টাইন, টমাস আলভা এডিসন,বেন ফ্রাংকলিন, সংঙ্গীতশিল্পী চের, ম্যারি মুর, আমেরিকান অভিনেতা হেনরি উইঙ্কলার ডিসক্যালকুলিক ছিলেন। এরা যে যার ক্ষেত্রে ছিলেন সফল। ডিসক্যালকুলিয়া হয়তো আপনাকে গনিতবিদ হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় তাই বলে কি জীবনের অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়।

 

 তথ্যসূত্র:

১.Badian, 1983; Gross-Tsur, Manor, & Shalev, 1996; Kosc, 1974; Lewis, Hitch, & Walker, 1994।

২.https://allaboutdyscalculia.weebly.com/history-of-dyscalculia.html.

৩.http://www.educational-psychologist.co.uk/sen-resources-blog/2016/1/22/dyscalculia-       assessment-and-diagnosis.

৪.https://www.etymonline.com/word/dys

৫.http://think-psych.com/child-psychologist-services/child-psychologist-counsellor/learning-disorders-dyslexia-dysgraphia-dyscalculia/?gclid=Cj0KCQjwoInnBRDDARIsANBVyARJZbSPRSugOZ0SyEKK5-NVVDQ3FhCnIDlfonnnyBcdEPmtRcD4i68aAi_PEALw_wcB

৬.https://www.gl-assessment.co.uk/products/dyscalculia-screener-and-guidance/

৭.https://www.dyscalculia.org/

৮.https://www.cognifit.com/pathology/dyscalculia

৯.https://www.google.com/amp/numberdyslexia.com/history-of-dyscalculia/amp/

১০.https://www.understood.org/en/learning-attention-issues/child-learning-disabilities/dyscalculia/understanding-dyscalculia

১১.https://www.researchgate.net/publication/273137402_Dyscalculia_and_mathematical_difficulties_Implications_for_transition_to_Higher_Education

১২.https://www.researchgate.net/publication/8224516_Mathematics_and_Learning_Disabilities

১৩.Dyslexia.com.au

১৪.http://www.aboutdyscalculia.org/causes.html

১৫.https://www.understood.org/en/community-events/blogs/the-inside-track/2015/08/04/im-a-successful-student-because-i-embrace-my-dyscalculia

Leave a Comment

Skip to content