ঠোঁট কাটা ও তালু কাটা রোগ: কারণ, রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সাধারণত যে সকল রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ থাকে তার মধ্যে ঠোঁট কাটা বা তালু কাটা অন্যতম। এটি আর দশটি রোগের মতোই, বিশেষপার্থক্য হলো এটি শুধুমাত্র জন্মগতভাবেই হয়। কুসংস্কারাচ্ছন্নতার কারণে বাংলাদেশে এটি অভিশাপ, জিন ভূতের প্রভাব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে ঠোঁট কাটা তালু কাটার চিকিৎসার হারও খু্ব কম। 

ঠোঁট কাটা

গর্ভে ভ্রুণ থেকে শুরু করে শিশুবিকাশের সময় চলাকালীন ঠোঁটের টিস্যু সঠিকভাবে বিকাশ না হলে ঠোঁট কাটা শিশুর জন্ম হয়। ঠোঁটের কাটার পরিমাণ সাধারণত উপরের ঠোঁটের সামনের থেকে শুরু করে নাকের ছিদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে।

তালু কাটা

গর্ভে শিশু বিকাশের সময় মুখের ভেতরের দিকের তালুর টিস্যু সঠিকভাবে গঠন না হলে তালু কাটা/ছিদ্রযুক্ত শিশুর জন্ম হয়। তালু কাটা প্রায়শই উপরের ঠোঁটের সাথে কাটাযুক্ত হয়ে থাকে, আবার ঠোঁটকে প্রভাবিত/সংযুক্ত না করে এককভাবেও হতে পারে 

যদি ঠোঁট কাটা থাকে তবে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্লেফট লিপ এবং তালু কাটাকে বলে ক্লেফট প্যালেট আর ঠোঁট কাটা ও তালু কাটাকে একত্রে ওরোফেসিয়াল ক্লেফট বলা হয়। 

জন্মের পূর্ববর্তী বিকাশজনিত সমস্যা অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত টিস্যুর বিকাশ না হওয়ার কারণেই সাধারণত ঠোঁট কাটা ও তালু কাটা হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় প্রথম ৫-৮ সপ্তাহের মধ্যে ঠোঁট, প্রাইমারি প্যালেট অর্থ্যাৎ এল্ভিওলার রিজের বিকাশ ঘটে এবং ৮-১২ সপ্তাহের মধ্যে সেকেন্ডারি প্যালেট অর্থ্যাৎ নরম ও শক্ত তালুর বিকাশ ঘটে। এসময় মায়ের দেহে মেটাবলিক সমস্যা, পুষ্টির অভাব হলে বা সঠিক পরিচর্যা না হলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হতে পারে। গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহ পর আল্ট্রাসাউন্ড করলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা কিনা তা জানা যায়।

পরিসংখ্যান

WHO এর মতে, বিশ্বে প্রতি ৭০০ জন নবজাতকের মধ্যে ১ জন শিশু ঠোঁট কাটা বা তালু কাটা নিয়ে জন্মে থাকে [২০০১]। IPDTOC এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে ঠোঁট কাটা (তালু কাটা সহ বা তালু কাটা বাদে) প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ৭.৯৪-৯.৯২ জনের মধ্যে দেখা যায় [২০১১]। এশিয়ানদের মধ্যে প্রতি ৫০০ জন নবজাতকের মধ্যে ১ জনের ঠোঁট কাটা তালু কাটা নিয়ে জন্মে থাকে [Dixon, Marazita, Beaty & Murray,2011]। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ঠোঁট কাটা (তালু কাটা সহ বা তালু কাটা বাদে) ছেলেদের বেশি হয় , তালু কাটা মেয়েদের বেশি হয়ে থাকে । 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় থেকে হাজার ঠোঁট কাটা তালু কাটা শিশু জন্মগ্রহণ করে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতি ৬০০ জন শিশুর মধ্যে জন শিশুর ঠোঁট কাটা তালু কাটা ত্রুটি থাকে। LMRF এর একটি রিসার্চ অনুয়াযী বাংলাদেশের যে সকল বাচ্চা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার মধ্যে ৬০% শিশুর ঠোঁট কাটা এবং ৩০% শিশুর তালু কাটা এবং লিঙ্গ ভেদে তা ৫৬% ছেলে এবং ৪৪% মেয়ে[২০১৪]।

কারন

ঠোঁট ও তালু কাটার সঠিক কারন যদিও এখনো নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি তবুও কিছু কিছু বিষয়কে কারণ-ফলাফল বিশ্লেষণে ঠোঁট ও তালু কাটার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন, 

  • বংশগত/জিনগত: পরিবারের আগে কারো এমন ইতিহাস থাকলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।  
  • বৈবাহিক সম্পর্ক; রক্তের সম্পর্কে বিবাহ হলে বা বাবা মায়ের জিনগত বৈশিষ্টের মিল থাকলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 
  • অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ; গর্ভাবস্থায় মা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নোংরা পরিবেশের ফলে মায়ের শরীরে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ হয় যার ফলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 
  • গর্ভবতী মায়ের বয়স বেশি হলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 
  • গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা  বেশি থাকে। 
  • গর্ভাবস্থায় মা মাত্রাতিরিক্ত মেডিসিন নিলে বা হেভিডোজের ড্রাগ নিলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • গর্ভবতী মা মাদকাসক্ত হলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 
  • গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবারের অভাব হলে শিশুর ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 
  • মানসিক স্বাস্থ্য; গর্ভাবস্থায় মানসিকভাবে চাপ বেশি অনুভূত হয় এছাড়া নানান মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, এসময় মাকে মানসিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ না দিলে তা বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলে যার ফলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা হয় বা হওয়ার সম্ভনা বেশি থাকে।

আমাদের দেশে ঠোঁট ও তালু কাটা হওয়ার মূল কারন হচ্ছে পুষ্টির অভাব। গর্ভাবস্থায় মা সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার পায় না , ভিটামিনের অভাব, খাদ্য তালিকায় খাবারের মান থাকে নিম্ন -যার কারন হলো আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র্য এবং সচেতনতার অভাব থাকে। পুষ্টির অভাবে গর্ভাবস্থায় মা নানান রোগে ভোগে যার ফলে শিশুর সঠিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটায় । এসব কারনে শিশু জন্মগতভাবে নানা রোগ নিয়ে জন্মগ্রহন করে।  

শ্রেণীকরণ

সাধারণত ঠোঁট ও তালু কাটা ৫ রকমের হয় __

  • একপাশ বা দুপাশ ঠোঁট কাটা
  • একপাশের ঠোঁট ও তালু কাটা
  • দুপাশের ঠোঁট ও তালু কাটা
  • সাবমিউকাস ক্লেফট
  • বিফিড ইভ্যুলা 

সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এমন ওরোফেসিয়াল ক্লেফট হলো__

  • শুধু ঠোঁট কাটা
  • শুধু তালু কাটা
  • ঠোঁট ও তালু উভয় কাটা

সমস্যা

ঠোঁট ও তালু কাটা থাকার ফলে নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। খাবার গ্রহন, চিবানো, গলাধঃকরন, শ্বাসগ্রহন জটিলতা, শব্দ উচ্চারণ করতে, কথা বলতে সমস্যা হয়। এছাড়া সামাজিক অবহেলার স্বীকার হওয়া, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়াটা ভাগ্যে পরিণত হয়।ওয়া নৈমিত্তিক রুটিনে পরিণত হয়।

  • ঠোঁট কাটা থাকার ফলে কথা বলতে বিশেষ করে ঠোঁটের সাথে সম্পর্কিত যেসব ধ্বনি ( প, ফ, ব,ভ, ম, ত, থ ইত্যাদি) তা উচ্চারণ করতে জটিলতা, গলাধঃকরণ ত্রুটি হয়, দাঁত উঠতে অসুবিধা হয়। 
  • তালু কাটা থাকার ফলে স্পষ্ট এবং ফ্লুয়েন্ট কথা বলতে পারেনা, বাতাস নাক দিয়ে বেশি বের হওয়ার ফলে কথা নাকে নাকে শোনা যায়, শ্বাসনালীতে খাদ্যপ্রদাহ সৃষ্টি হয়। 

ডায়াগনোসিস

ঠোঁট কাটা সহজে শনাক্ত করা যায়। তালু কাটা সহজে শনাক্ত করা যায় না, শনাক্ত করার জন্য MRI করার প্রয়োজন হয়। এছাড়া গর্ভাবস্থায় ১২ সপ্তাহ পর আল্ট্রাসাউন্ড করলে বাচ্চার ঠোঁট ও তালু কাটা কিনা তা জানা যায়। 

ঠোঁট ও তালু কাটার সাথে আরো বিভিন্ন বিকার (Impairment) সংযুক্ত থাকতে পারে। যেমন—

  • স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ ডিসঅর্ডার
  • লার্নিং ডিজাবিলিটি
  • কগ্নিটিভ ডিজাবিলিটি
  • সাইকোলজক্যাল প্রবলেম 
  • ইয়ার ইনফেকশন

 

         সার্জারির পরে
সার্জারির আগে

চিকিৎসা

ঠোঁট ও তালু কাটা ঠিক করার চিকিৎসা পদ্ধতি ২ ধাপে হয়।

  • সার্জারি/অস্ত্রপাচার
  • স্পিচ থেরাপি

অস্ত্রপাচার শেষ হওয়ার পর থেরাপি শুরু হয়। সাধারণত সার্জারির তিন সপ্তাহের পর থেকে থেরাপি শুরু হয়। থেরাপির ৬-৭ টা সেশন শেষ হলে আবার আরেকটি সার্জারির প্রয়োজন হয়, অনেক শিশুর একাধিক সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। বর্তমানে অনেক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে তাই সময়মতো সঠিক চিকিৎসা হলে শিশুর যে ঠোঁট কাটা ছিলো বা মুখে কোন ডিফেক্ট ছিলো তা বোঝা যায় না। 

সার্জারি:

ঠোঁট ও তালু কাটা শিশুর সার্জারি জন্মের ৩ মাস পরেই শুরু করা হয়। এতে শিশুর ভাষা বিকাশ ভালো হয়, স্বাভাবিক শিশুর মতো কথা বলা শিখে যায়। দেরি করলে সমস্যা আরো বাড়তে থাকে। তাই জন্মের পরপরই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে সার্জারি করে নেয়া ভালো । যে সকল সার্জারি বর্তমানে প্রচলিত আছে তা হলো— 

  • ফুরলো প্যালাটোপ্লাসটি
  • ফেরিংগাল ফ্রাপ
  • পোস্টেরিওর ফেরিংগাল ওয়াল ইঞ্জেকশন অগমেন্টেশন
  • ইসফিনিক্টার ফেরিংগোপ্লাসটি
  • প্লাস্টিক সার্জারি 

স্পিচ থেরাপি:

রোগীর অবস্থা বুঝে তাকে থেরাপি প্রদান করা হয়। থেরাপি এক একজনের একেক রকম হয়। মুখের যে যে অংশগুলো ধ্বনি উচ্চারণে ব্যবহৃত হয় সেগুলো আগে ঠিক করে তারপর স্পিচ থেরাপি শুর করা হয়। অনেকগুলো সেশনে ভাগ করে থেরাপি দেয়া হয়। অনুশীলন, প্রশিক্ষণ এবং কিছু কৌশল দ্বারা একজন স্পিচ থেরাপিস্ট এক এক করে আওয়াজ করে শেখানো থেকে শুরু করে অনর্গল কথা বলতে শিখান। কাজটি কঠিন কিন্তু থেরাপি কম বয়সে শুরু করলে তা সহজ হয়। যে যে ধরনের থেরাপি দেয়া হয় তা হলো—

  • অনুশীলনমূলক থেরাপি
  • কৌশল রপ্ত করানো
  • মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা
  • ফলো আপ কেয়ার
  • স্বাস্থ্যকর পরিবেশ 
  • বন্ধুসুলভ আচরণ

ঠোঁট ও তালু কাটার সাথে অন্যান্য সমস্যা থাকে বা থাকতে পারে। তাই যদি এরকম সমস্যা দেখা দেয় তাহলে অন্য চিকিৎসকের কাছে রেফার করতে হবে। অনেকজনের সম্মিলিত চিকিৎসায় ঠোঁট ও তালু কাটা ঠিক হয়। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সঠিক চিকিৎসায় ঠোঁট ও তালু কাটা সমস্যা দূর হয়, তাই একটি শিশুকে সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। তাই নিজে সচেতন হই এবং অন্যকেও সচেতন করি। 

লেখক
সুমাইয়া রেফা
ব্যাচেলর ইন স্পিচ এ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজি (ঢাবি)
এম এস এস ( অধ্যয়নরত) যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

তথ্যসূত্র

  1. https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/cleft-palate/symptoms-causes/syc-20370985
  2. https://www.cdc.gov/ncbddd/birthdefects/cleftlip.htmlb
  3. https://www.nhs.uk/conditions/cleft-lip-and-palate/
  4. https://www.enthealth.org/conditions/cleft-palate/
  5.   https://www.clapa.com/what-is-cleft-lip-palate/

Leave a Comment

Skip to content