বার্ধক্য এবং যোগাযোগ বৈকল্য

যোগাযোগ ব্যাপারটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের কথা বলা, ভাষা ব্যবহার, শ্রবণ, গলাধঃকরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসে। এরই ধারাবাহিকতায় কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তন সাধিত হয় যোগাযোগ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বয়সের সাথে কোন পরিবর্তনটি স্বাভাবিক এবং কোনটি স্বাভাবিক নয় সেটা বিবেচ্য বিষয়। একজন বয়স্ক মানুষ তার জীবদ্দশায় এক বা একাধিক যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত হতে পারেন। আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকি তো আছেই। উল্লেখ্য স্ট্রোকের রোগীদের ভাষা এবং বাচন বৈকল্যে আক্রান্ত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকে।

বয়সের সাথে শ্রবন বৈকল্য

এ কথা বলা চলে যে, প্রায় প্রতিজন বয়স্ক মানুষই কোনো না কোনো শ্রবণ সমস্যায় ভুগে থাকেন। জরিপে দেখা গেছে, পঁয়ষট্টি বয়সোর্ধ্ব মানুষের যতগুলো স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তন্মধ্যে শ্রবণ সমস্যা চতুর্থ ।

বয়স বাড়ার সাথে কানের গঠন এবং কানের শারীরতত্ত্বিক বিভিন্ন পরিবর্তন হয়, যেমনঃ বহিঃকর্ণে লোমের আধিক্য, কর্ণছত্রের তরুণাস্থি দুর্বল হয়ে যাওয়া, টিমপ্যানিক পর্দা মোটা অথবা পাতলা হয়ে যাওয়া। মধ্যকর্ণের ছোট্ট হাড্ডিসমূহের (ম্যালিয়াস, ইনকাস, স্টেপস) স্থানচ্যুতির ফলে শব্দতরঙ্গ সঞ্চালনের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। ইউস্টেশিয়ান টিউবের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাসের কারণে কথা বললে মনে হয় যেন পাইপের এক প্রান্ত থেকে কেউ কথা বলছে আরেকপ্রান্ত থেকে শ্রোতা শুনছেন। অন্তঃকর্ণের ককলিয়ার স্নায়ু চুলগুলোর মৃত্যু অথবা কর্মক্ষমতা হ্রাস, বিশেষ করে ককলিয়াচূড়ের লোম কমে যাওয়ার কারণে নিচু স্বরের শব্দ বা কথা শোনা অসম্ভব হয়ে যায়। ককলিয়ায় রক্ত প্রবাহ কমে যাওয়াও একটি বিশেষ পরিবর্তন।

যেহেতু মানুষের কান একই সাথে শ্রবণ এবং ভারসাম্য রক্ষার ভূমিকা পালন করে তাই শ্রবণ ত্রুটির সাথে সাথে ভারসাম্য ত্রুটিও বয়সের সাথে মানুষের উপর ভর করে। বয়স্ক মানুষেরা তাই প্রায়ই ভারসাম্য রাখতে না পারার দরুণ হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।

বার্ধক্যজনিত শ্রবণ সমস্যা যদিও সম্পূর্ণরূপে এড়ানো সম্ভব নয়, তবুও কান পরিষ্কার রাখা, উচ্চশব্দ ও উচ্চচাপ থেকে কান বাঁচিয়ে চলা, ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করলে বার্ধক্যজনিত শ্রবণ সমস্যা তথা presbycusis (রেসবিকিউসিস) অনেকখানি এড়ানো সম্ভব।

বার্ধক্যজনিত কথা, ভাষা এবং খাদ্যগ্রহণ বৈকল্য

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কথা-বার্তা, ভাষা এবং খাবার গ্রহনে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়। তারমধ্যে দাঁত পড়ে যাওয়া এবং দাঁতের বিন্যাস সমস্যাটি অন্যতম। তাছাড়া এর ফলে চোয়াল, জিহ্বা, লালাগ্রন্থি এবং গলাতে টিস্যু, গ্রন্থিবিশেষ এবং স্নায়ুবিক পরিবর্তন হয়। পাশাপাশি লালাগ্রন্থির সংখ্যাহ্রাস এবং স্বাদগ্রহণ ত্রুটিও দেখা যায়। এই স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলি বয়স্কদের খাবারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। দাঁতের অবস্থা ও খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে বয়স সম্পর্কিত পরিবর্তন অনেকক্ষেত্রে অপুষ্টির কারণ হিসেবে উদয় হয়। কেননা, বয়স্করা চিবানো এবং খাবার গ্রহণের সুবিধার্থে ক্ষেত্রবিশেষে বিকল্প অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে। আবার কিছু বয়স্ক ব্যাক্তি অপর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার গ্রহণের ফলে তাদের ওজন হ্রাস এবং পুষ্টিহীনতার সমস্যা সৃষ্টি হয়। কোনো বয়স্ক ব্যক্তি যদি খাবার গ্রহণে সমস্যা বোধ করেন তবে তার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোগ নির্ণয় করতে হবে।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, কণ্ঠ প্রক্রিয়াটি বয়স দ্বারা প্রভাবিত হয়। দূর্বলতা, তীব্রতার হ্রাস, কর্কশ কণ্ঠস্বর, কন্ঠস্বরে কম্পনের পরিবর্তন (pitch level) প্রায়ই বয়স্কদের কন্ঠস্বরকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে।

কন্ঠস্বরের পরিবর্তন প্রক্রিয়াটি গলার অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। বয়স সম্পর্কিত কিছু সাধারন পরিবর্তন বয়স্কদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি, তরুণাস্থির কঠোরতা। তাছাড়া কন্ঠস্বরে স্বল্প রক্ত সরবরাহ, গলায় সংক্রমণ এবং নিঃশ্বাসের স্বল্পতা শব্দ উৎপত্তিতে প্রভাব ফেলে। সমবয়সী নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রেই এ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একদিকে যেমন পুরুষদের কন্ঠস্বরের মাত্রা বৃদ্ধি পায় অপরদিকে নারীদের মাত্রা হ্রাস পায়। বয়সের সাথে সাথে পরিস্থিতির সাথে মিল রেখে স্বরের তারতম্য কম-বেশি হয়। কেননা স্নায়ুপেশির উপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়। ভোকাল কর্ড শিথিল হয়ে যায়। প্রায়ই বয়স সম্পর্কিত এ সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো পেশাগত জীবনে এবং দৈনন্দিন জীবনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।

বয়স্কদের ভাষাদক্ষতার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের অনেকগুলো প্রকার রয়েছে। ভিন্নতাগুলো মূলত স্বতন্ত্র জীবনধারা, ভাষাদক্ষতা, যোগাযোগের পরিবেশ এবং জ্ঞানধারনের সক্ষমতার কারনে হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং ভাষায়ও কিছুটা পরিবর্তন হয়। এসবের মধ্যে মনযোগের ঘাটতি, স্মৃতি হ্রাস ও স্বল্পগতিতে তথ্য প্রক্রিয়াকরন অন্যতম। বয়স্কদের অনেকবড় একটি অংশ তাদের জীবনের কোনো এক সময় মনে না থাকা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নাম মনে করা কিংবা একটি নিত্যব্যবহার্য পরিচিত শব্দ মনে করতে বেগ পেতে হয়। প্রায়ই এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কোন পুর্নবয়স্ক ব্যক্তি যদি কোনো পরিচিত জিনিসের জন্য শব্দ খুঁজে না পায় কিংবা সঠিক শব্দচয়নের সমস্যার সম্মুখীন হন তবে তার উচিত একজন ভাষাচিকিৎসকের (Speech and Language Pathologist) শরনাপন্ন হয়ে সমস্যা যাচাই করে নেয়া।

সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শব্দ সনাক্তকরণ সমস্যাগুলি বা ডিমেনশিয়া (dementia) থাকলে সাধারণত চিকিৎসক তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন।

সাধারণত বয়স্করা অল্পবয়সীদের চেয়ে সহজ বাক্যগঠন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। তারা কথোপকথনে অপেক্ষাকৃত ছোট বাক্য ব্যবহারের দিকে ঝোঁকেন। আবার তারা কথোপকথনে জড়িত থাকতেও পছন্দ করেন এবং অন্যান্য পরিবর্তনগুলো এই বিষয়টার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। শ্রোতাকে আকৃষ্ট রাখতে এবং শ্রোতাদের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে তাদের কথোপকথনের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে থাকেন। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, বয়স্কদের বেশিরভাগই তাদের যৌবনের দশ বছর সময়কালের মৌলিক কথোপকথন রীতি বজায় রাখেন।

মোদ্দা কথা হলো, বয়স্কদের নিয়মিতভাবে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। যোগাযোগের সাথে জড়িত থাকার ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং প্রতিদিনের ঘটনাগুলির সাথে সংযুক্তি বাড়বে।

(লেখাটি American Speech-Language-Hearing Association (ASHA) এর প্রকাশিত ম্যাগাজিন Let’s talk এর জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত)

মূল লেখক: ডেবরা বুসাকো

ভাবানুবাদ: আব্দুল্লাহ ভূঁইয়া এবং মাসুম বিল্লাহ।

Leave a Comment

Skip to content