বিশেষ শিশু এবং কিছু কথা

বিশেষ চাহিদা ডায়াগনোসিস বা রোগনির্ণয় এর জগতে একদম সাধারণ একটা ব্যাপার।বিশেষ চাহিদার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ এর অনেকের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই অসম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, একজন বিশেষ চাহিদার মানুষ হলো সে যে অন্য দশটা রোগীর থেকে ভিন্ন এবং তাদের থেকে বেশি যত্ন, সহমর্মিতা এবং সচেতনতা পাওয়ার অধিকার রাখে।মনে রাখতে হবে এটা আমাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি দয়া না। এটা তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য এবং তাদের অধিকার।

উপরে বলা নেতিবাচক কথাগুলোকে এবার একটু ইতিবাচক করা যাক। কারো উন্নয়নের বিকাশ, শারীরিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা, জন্মগত অবস্থার উন্নয়নের ক্রমধারার প্রতি নজর রাখলে একটা বাচ্চা তার প্রয়োজনীয় বিকাশ এর ধাপগুলা পূরণ করতে পারে। এবং সে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।সব বাচ্চার জন্যই এমন একটা ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন চার্ট করা যায়। এই চার্টটি বাচ্চার বাবা মাকে এবং তার পরিবারকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়। ক্রমবিকাশ এর ধাপগুলা সম্পর্কে আন্দাজ করতে সাহায্য করে। বাচ্চার উন্নতি হচ্ছে কিনা বা বাচ্চা এরপর কি করতে পারে বা আমরা বাচ্চার জন্য কি কি কাজ করতে পারি তা এই চার্ট থেকে বোঝা সম্ভব।

চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য
আমরা ভাবি যে যেই বাচ্চাটার বিশেষ চাহিদা রয়েছে তারা এই কাজ করতে পারবে না, তাদের হাতে এটা দেয়া যাবে না, সেটা দেয়া যাবে না, তাকে অমুক তমুক খেতে দেয়া যাবে না, এভাবে কথা বলা যাবে না, তার জন্য এসব কিছু নিষেধ, তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা লাগবে ইত্যাদি। অনেক সময় এমন বাধাগুলাই তাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। বাবা মা নিজেদের ছোট ভাবেন। অনেক সময় ভাবেন তাদের সন্তানের কারণে তারা ছোট হচ্ছেন। উপরে যেই চার্টটার কথা বলা হয়েছে সেটা কিন্তু এই “বিশেষ” নামটার ফাঁদে পড়ে কোন কাজ করতে পারবে ন। কারন দেখা যাবে চার্ট অনুযায়ী এমন কিছু বলা হয়েছে যাতে একটা কাজ যেভাবে সবাই করে সেটা “বিশেষ” বাচ্চাটা করে দেখাক। অনেক সময়ই সেটা সম্ভব হয় না ফলে চার্টটা তার জন্য কোন কাজে আসে না। অনেক পরিবারের perception (দৃষ্টিভঙ্গি) হচ্ছে আমার বাচ্চার কিছুই হবে না।

আবার অনেক ফ্যামিলির সহযোগিতা কিন্তু একটা “বিশেষ” বাচ্চার কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পারে। বাবা মা ওকে উৎসাহ দিলে সে খুশি হয়ে উঠবে। প্রায়ই দেখা যায় আমরা যাদের “বিশেষ” বলি তাদের একদিকে একটু দুর্বলতা থাকলেও অন্যদিকে তারা এতো বেশি প্রখর হয় যে তাদের মেধা ধারণ করার যোগ্যতা এই পৃথিবীর গৎ বাধা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না।

প্রত্যেকটি পরিবারের আলাদা পরিকল্পনা থাকে
বিশেষ চাহিদার দুইজন বাচ্চাকে দেখতে থাকলে বোঝা যায় তাদের মধ্যে খুব কম জিনিসের মিল রয়েছে। যেই বাচ্চার উন্নয়ন এর ক্রমবিকাশ ধীরে হচ্ছে তার সাথে দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা সম্পন্ন কোন বাচ্চার খুব কম মিল পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে ল্যাংড়া (Cerebral Palsy) তে আক্রান্ত কাউকে দেখলেও আমরা অটিস্টিক বলি আবার যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা আছে (Intellectual Disability) তাদেরকেও আমরা অটিস্টিক বলি। যেখানে অটিস্টিক সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা টার্ম। অনেক পরিবারই এই পার্থক্য করতে পারেন না। সবার এটা জানা থাকা উচিত যে প্রত্যেকটি কেস এখানে unique (অনন্য)। বাবা মায়েদের উচিৎ এসব ব্যাপারে খোঁজখবর করা এবং তার ছেলের আসলে কি হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা।


চিকিৎসার বিষয়াবলী
ক্যান্সার, হার্টব্লকেজ, মাস্কুলার ডিসট্রফি ইত্যাদি হলেই হাসপাতালে দৌঁড়াই। আজমা ডায়াবেটিকস হলেও ঠিকই যাই জায়গামত। জন্মগত সমস্যা যেমন – Cerebral Palsy (জন্মগতভাবে শারিরীক অংগে সমস্যা), Dwarfism(জন্মগতভাবেই খাটো),ফুড এলারজি, জিনগত কারণে মোটা হওয়া (obesity) ইত্যাদির জন্যও হাসপাতালে যায় না অনেকে। এসব হলেও মেডিক্যাল টেস্টিং, টেস্টিং মেশিন, হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন রয়েছে কিছুক্ষেত্রে। অনেকে ভাবেন এগুলার কোন পরিবর্তন হয় না কিন্তু সঠিক ট্রিটমেন্ট করলে পেশেন্ট এর ইম্প্রুভ হয়। এবং সুস্থ সাধারন জীবনেও ফিরিয়ে আনা যায়।

আচরণগত বিষয়াবলী
অনেক বিশেষ বাচ্চাদেরই আচরণগত সমস্যা রয়েছে। যাদের ADHD(Attention Deficit Hyperactivity Disorder) রয়েছে তারা অনেক বেশি চঞ্চল হয়, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে চায় না এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা প্রচন্ড মেধাবি হয়। অনেক সময় মা ধুমপান বা মাদকদ্রব্য এর সাথে জড়িত থাকলে বাচ্চার নানারকম সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায় যেমন- বাচ্চার মাথা তুলনামুলক ছোট হয়, নাক এর গঠন ঠিক থাকে না, উপরের ঠোট পাতলা থাকে, কানের গঠন ঠিক থাকে, লম্বা হয় না ঠিকমত, মেরুদন্ড বাকা থাকে, হার্ট এ সমস্যা থাকে ইত্যাদি।এদেরকে Fatal Alcohol Spectrum Disorder(FASD) বলে। এদের ব্যবহারও সাধারণ বাচ্চাদের মত হয় না। তারপর রয়েছে Tourettes Syndrome (কিছু ওষুধ এর কারণে বাচ্চার মস্তিস্কে আঘাত করে) যেটার কারণে অনেকে ডিপ্রেশন এ থাকতে পারে এবং মানুষের সাথে মিশতে পারে না।

১২৯ রকমের ওষুধ রয়েছে যেগুলো প্রেগন্যান্সির সময়ে খেলে সন্তানের ক্ষতি হয় এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

উন্নয়নের বিষয়াবলী
যেসব বাচ্চাদের উন্নয়নের ক্রমবিকাশ এ সমস্যা যেমন Intellectual Disability, Down Syndrome তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বানাতে হলে কিছু জিনিস নিয়ে আগে ভাল মতে চিন্তা করতে হয়। আগে থেকে সতর্ক না হলে পরে হুট করে ধাক্কা খেতে হয় এই বাচ্চাগুলোর। তাদের জন্য কোন পরিকল্পনা বানাতে গেলে অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হয়, যেমনঃ তাদের সবার মত প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় দেয়া যাবে কিনা? অনেক বাবা মা ভাবেন সবার মত তার বাচ্চাকেও সাধারণ স্কুল এ দিবেন, ফলে বাচ্চাটির লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশি হয়। কারণ সে প্রতিযোগিতা করে পেরে ওঠে না। আবার সে স্বাভাবিক ভাবে perceive (গ্রহণ করা) করতে পারে না। তাই বাবা-মায়ের উচিৎ প্রচলিত পদ্ধতিতে স্কুলিং না করে বিশেষ উপায়ে স্কুলিং এর চিন্তা করা। ঠিকভাবে পড়ছে কিনা এবং থেরাপি পাচ্ছে কিনা তার খোঁজ রাখা।

শিখনের বিষয়াবলী
অনেক বাচ্চাই রয়েছে যাদের শিক্ষা অর্জন এর সমস্যা রয়েছে যেমন – Dyslexia (পড়তে সমস্যা, বানানে সমস্যা, স্পষ্টভাবে পড়তে না পারা) এছাড়া (অতিরিক্ত ভুল করা), এছাড়াও রয়েছে APD-Auditory Processing ডিসরদের (শব্দ আর অক্ষর এর শব্দের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারা)
Dysgraphia (লিখতে সমস্যা, বেশি ফাকা লেখা) ইত্যাদি বিভিন্ন শিখনজনিত সমস্যা হতে পারে। তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োজন তাদের নিজেদের উন্নতির জন্য এবং লক্ষে পৌঁছানোর জন্য। এটা তাদের আচরণগত উন্নয়ন এর জন্যেও দরকার। এসব বাচ্চাদের বাবা মায়েদের উচিৎ খুব দৃঢ় মানসিকতার হওয়া। এতে তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের শিখনের সুবিধা হবে। স্কুলে শিক্ষকের পাশাপাশি বাসায়ও বাচ্চাদের হাতে ধরে ধরে সব শিখানো উচিত যাতে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের নাগালে পায়। এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে বাবা মায়েদের সবসময় বাচ্চাকে চর্চার উপর রাখতে হবে তা নাহলে বাচ্চা দ্রুত সব ভুলে যাবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়াবলী
আপনি যখন দেখবেন আপনার বাচ্চাকাচ্চার কষ্ট হচ্ছে কিছু করতে গিয়ে। বা নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাচ্ছে কোন কারণে। তখন মাথায় রাখবেন যে এসব অবস্থার জন্য সবসময় নিজে প্রস্তুত থাকতে হবে, এসব অবস্থা অনেক সময়ই আপনার মেজাজ পরিবর্তন করে দিতে পারে, অনেক ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে, চিল্লাচিল্লি, হুড়োহুড়ি ইত্যাদি অনেককিছুই হতে পারে। এ সময় নিজেকে শান্ত রেখে ধীরে ধীরে কাজ করে যেতে হবে দরকার মত। আপনার উচিত হবে সময়মত বা সঠিক অবস্থামত একজন দক্ষ থেরাপিস্ট বা ক্লিনিশিয়ান এর সাথে যোগাযোগ রাখা যিনি তৎক্ষণাৎ আসতে পারবেন অথবা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।
আপনার থেরাপি,ওষুধ,হাসপাতাল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া লাগবে।

শেষ কথা
প্রত্যেকটি বাচ্চাই প্রত্যেকের চেয়ে আলাদা এবং সব পরিবারই ভিন্ন। সব বাবা মা ই চায় সন্তানের উন্নতির জন্য।সবাই চায় তার বাচ্চা সঠিক যত্ন পাক এবং তার বাচ্চাকে সমাজ, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্যরা মেনে নিক। স্কুল কলেজে পরিবারে যথাযথ মর্যাদা পাক। অনেকেরই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। এর জন্য আপনার বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নের সব সামগ্রী গুছানো থাকলে আপনার জন্যই সুবিধা হবে বাচ্চাকাচ্চার উন্নয়নের জন্য কাজ করা। একটা জিনিস প্রায়ই দেখা যায় যে সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে “বিশেষ” চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাদের বাবা মায়েদের চিন্তা অনেক বেশি থাকে তাদের বাচ্চার জন্য।

তারা বাচ্চার জন্য অনেক কিছু করেন, বাচ্চাদের নিয়ে তারা বেশি স্বপ্ন দেখেন, এবং সবসময় তাদের উন্নয়নের জন্য লেগে থাকেন। আমাদের উচিত এসব বাচ্চাদের সাহায্য করা এবং তাদের জন্য কাজ করা যাতে তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।অনেক বাবা মায়েরাই এখনও সচেতন না তাদের বাচ্চাদের সম্পর্কে। তাই আমাদের এই সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের উচিত যতটুকু সম্ভব করা তাদের জন্য। তবেই আমাদের সকল শিশু হবে আগামীর ভবিষ্যৎ।

লেখক
শোয়েব আদনান
শিক্ষার্থী, PISER, BUP

Leave a Comment

Skip to content