বৈচিত্রের পৃথীবি

অটিজম বা ডিজঅর্ডার কিংবা কোনো যোগাযোগ ত্রুটি সামাজিক ব্যাধি নয়, আমাদের দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতা মাত্র।

কারো চোখের আইরিশের রঙ নীল বা সবুজ হলে যেমন আমরা বলতে পারি না সে অসুস্থ কিংবা গালে টোল পড়লেও বলতে পারি না তার ডিজঅর্ডার আছে তেমনি শুধু মাত্র কারো জিনগত বৈচিত্রের কারনে আমরা তাদের বলতে পারি না তারা অসুস্থ। পরিবারে থাকা একেকজন একেক রকম থাকে৷ কেউ রগ চটা থাকে, কেউ একটুতেই কান্না করে ফেলে। তাই বলে কি আমরা তাদেরকে পরিবার থেকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করি? তাহলে শুধু মাত্র সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টির বৈচিত্রের কারনে আমরা এই মানুষগুলোকে কেন অবহেলা করি?

আমাদের আশেপাশে অনেক এমন শিশু আছে যারা জিনেটিক ভিন্নতা কিংবা স্নায়বিক কারনে আমাদের অবহেলার স্বীকার হয়। নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন তো আপনি নিজেও সমাজের এই গন্ডিটা পেরোতে পেরেছেন কিনা?

আমাদের সবার চলাফেরার ধরণ ভিন্ন, আচরণ ভিন্ন, জীবন দেখার দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। কিন্তু ভুক্তভোগী শিশুদের মৌলিক আচরণগত ভিন্নতা থাকে। আমরা নিজেদের ভিন্নতা নিজেরা সৃষ্টি করি, কিন্তু তাদের ভিন্নতার জন্য তারা দায়ী নয়। সেটা প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী ঘটে। এই হলো সাধারণ এবং ভুক্তভোগী শিশুর মধ্যকার পার্থক্য।

আমরা স্বাভাবিকভাবে এমন সব কাজ করতে পারি, যা তারা পারে না। তার মানে যে তারা সমাজের হেয় মানসিকতা বা অবহেলার স্বীকার হবে, তা মোটেও কাম্য নয়। যদিও বর্তমানে সামাজিকভাবে এদের পরিচর্চা বা গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে জনসাধারণকে অবহিত করার লক্ষ্যে বহু সংস্থা উদ্যোগ নিচ্ছে, যথাসম্ভব সর্বত্র পৌছে তারা জনসতর্কতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় কাজ করছে। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সহায়তা করা হচ্ছে সামাজিকভাবে অটিজম বা ডিজর্ডারস সম্বন্ধীয় সতর্কতা এবং পরিচর্যার প্রসারের লক্ষ্যে। তবে, এর জন্য শুধু সামাজিক সংস্থাই কাজ করবে তা নয়। আমাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ না পাল্টালে সমাজ একই অজ্ঞতার মাঝে অবস্থান করবে।

একজন বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত শিশু (ক্ষমতা প্রাপ্ত এ কারনে যে আমাদের যা কিছু আছে তার থেকে ঢের কম নিয়ে তারা পৃথিবীতে বেশ ভাল রকম অবদান রেখে গেছে এবং যাবে)… হয়তো সে ঠিকমত হাঁটতে পারে না, হয়তো ঠিক মতো দেখতে পারে না, কোন কিছু আমাদের মত করে সহজভাবে বুঝতে পারে না, কথা বলতে পারে না, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। হয়তো সে আমাদের মত সাধারণ মানুষ না। তবে তারাও তো মানুষ। বরঞ্চ তারা সৃষ্টিকর্তার উপহারস্বরূপ জন্মগ্রহণ করে। আমরা যেসব সুবিধা ভোগ করে বেঁচে আছি, সেসব তাদেরও প্রাপ্য। তারাও সমাজের অংশ। সমাজের অবিচ্ছেদ্য জনবল তারা। সুষ্ঠু মানসিক এবং শারীরিক পরিচর্যা তাদের সমাজে আমাদের সমমানের অবদান রাখতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু তাদের এরূপ অবদানে সংযুক্ত হতে আমাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

এই সহযোগিতা আমাদের মানবিক এবং সামাজিক কর্তব্য।

একটি অটিজম বা ডিজর্ডারস আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিক মৌলিক কার্যক্রমে অক্ষম হলেও তারা কোন না কোন ক্ষেত্রে বহু স্বাভাবিক শিশুর থেকে অনেকাংশে পারদর্শী হয়। যেমনঃ কেও ভালো গাইতে পারে, কেও নাচতে পারে, কেও আঁকতে পারে, কেও ভালো সাহিত্য রচনা করতে পারে, কেও কম্পিউটারে পারদর্শী, কেও গেইমসে পারদর্শী ইত্যাদি আরো অনেক ক্ষেত্রে তারা পারদর্শী হতে পারে। তাদের বিশেষত্বগুলো খুঁজে বের করে তাদের সে ক্ষেত্রে উৎসাহিত করে উদ্বুদ্ধ করলে তারা সমাজ ও দেশের জন্য জনশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে।

বহু বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি অটিজম বা ডিজর্ডারে আক্রান্ত। যেমন: বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী Stephen Hawking ছিলেন ALP(Amyotrophic Lateral Sclerosis) আক্রান্ত, এছাড়াও আমেরিকান বিখ্যাত গণিতবিদ John Nash ছিলেন Schizophrenia আক্রান্ত, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি Christy Brown ছিলেন Cerebral Palsy আক্রান্ত। কিন্তু তারা তাদের বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শীতা দেখিয়ে আমাদের মত স্বাভাবিক মানুষদের অবাক হতে বাধ্য করেছেন। আমরা অনেকেই তাদের আদর্শ মনে করি, তাদের মত গুণী হতে চাই। সেরূপ আমাদের আশপাশের ভুক্তভোগী শিশুরা পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে তারাও পারবে বিশ্বের বুকে পদচিহ্ন আঁকতে। তা আপনার মনেও যে প্রশান্তি আনবে তা বলার বাহুল্য।

তারা যদি সমাজে পিছিয়ে থাকে তবে এর দায় আমাদেরই নিতে হবে। আমরা আমাদের সামাজিক এবং মানবিক কর্তব্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হব।

এরজন্য ভুক্তভোগীদের দিকে আঙুল না তুলে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো প্রয়োজন।

Dr. O. Ivar lovaas বলেছেন, “If they can’t learn the way we teach, we teach the way they learn. “

লেখক
সামিউল পার্থ
শিক্ষার্থী, যোগাযোগ বৈকল্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment

Skip to content