সামাজিক দূরত্ব, কিংবা আরো যথাযথভাবে বললে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বর্তমানে আমাদের জীবনযাত্রার নতুন ধরণ। এটি কঠিন এবং সীমিত সময়ের জন্য হলেও বর্তমানে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শারীরিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা সামাজিকভাবে একত্র হওয়ার উপায় বের করি।
আমরা বন্ধু-বান্ধব এবং আত্নীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগের জন্য কল, ভিডিও চ্যাটের ব্যবহার করি, কৌতুক কিংবা গল্প ই-মেইল করি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করি। ভার্চুয়াল জীবনে আমরা অন্যান্য কাজের মাধ্যমের সামাজিক যোগাযোগ রাখি যেমন সেবামূলক কার্যকলাপ, শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অনলাইন ক্লাস, কনসার্ট, এমন আরো অনেক কিছু। সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার্থে আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগের নতুন উপায় বের করতে হবে।
ভাষাগত বিকাশজনিত বৈকল্য যে শিশুদের রয়েছে, তাদের জন্য সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সাধারণ সময়েও চ্যালেঞ্জিং হয়। তাই শারীরিক দূরত্ব তাদের এই যোগাযোগের সমস্যাকে সম্ভাব্যভাবেই আরো তীব্র রূপ দেয়।তারা এই বিশেষ পরিবেশে, ভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা অনুশীলন করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে না। যদিও যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাযুক্ত শিশুদের জন্যও শারীরিক দূরত্ব মানেই সামাজিক দূরত্ব নয়।
বাচনভঙ্গি এবং ভাষার রোগবিদ্যাবিৎগন নানা কৌশলের মাধ্যমে বাচনিক এবং অমৌখিকভাবে সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশ করেন।চিকিৎসার মাত্রাকাল এখন যদিও এক নয় তবে এসএলপিগণ এখনো কঠিন সময়ে অন্যান্য সেবাদানের মডেল যেমন টেলিযোগাযোগ এবং বাড়িতে থেকেই সেবাদান প্রক্রিয়া দ্বারা শিশু এবং তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে পারেন।
নিচের পরামর্শগুলোর কয়েকটি অথবা সবগুলোই ভাষাগত অক্ষমতাজনিত শিশুদের পরিবার এবং ক্লায়েন্টদের সাথে এই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে টেলিযোগাযোগ এর মাধ্যমে শেয়ার করুন যেন তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সময় নির্ধারণ :
স্বাভাবিকভাবেই গৃহে অবস্থানকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সময় বাড়বে। কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে, পর্দার পেছনের নিঃসঙ্গ এই যোগাযোগের দরুন বাচন এবং ভাষার বিকাশে বিলম্ব হতে পারে। তবে আপনি শিশুর পরিবারকে একসাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে এবং সেগুলোকে যেকোনো বয়সী শিশুর সাথে আলোচনা করার জন্য উৎসাহিত করতে পারেন। বাবা-মা কিছু প্রশ্ন করতে পারেন যেমনঃ “তোমার পছন্দের চরিত্র কোনটি ছিল?”, “তোমার কি মনে হয় এরপর কি ঘটবে?”, ” অনুষ্ঠানটি এভাবে কেন শেষ হলো?” অথবা আপনি এমন এপ্লিকেশনের সুপারিশ করতে পারেন যা তাদের ভাষার বিকাশে সাহায্য করবে।
কথপোকথনের সুযোগ দেওয়া :
শারীরিক দূরত্ব সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে অথবা কমাতে পারে। পরিবারগুলো হয়তো একত্রে বেশি সময় কাটাতে পারে, তবে এছাড়াও বাবা-মার আর্থিক অবস্থা, চিকিৎসা, যৌথ পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রের নানা দায়িত্বের দিকে মনোযোগ থাকতে পারে। তাদের সমৃদ্ধ কথোপকথনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সুপারিশ করুন, যেমন-
নির্দিষ্ট ধাপ মেনে রান্না করা, পাজেলের সমাধান করা (একই রং, আকার,আকৃতির টুকরো খুঁজে বের করা), ভাষার ব্যবহার বেশি এমন বোর্ড গেম খেলা (নিয়ম নিয়ে কথা বলা, নিজের পালা আসলে কথা বলা এবং কৌশল নিয়ে বলা), বাইরে হাঁটা (তারা কি দেখে তা নিয়ে আলোচনা করা) এবং ঘরের বিভিন্ন রুম বিশ্লেষণ করা (কোন রুমে কি আছে তা নিয়ে কথা বলা)।
সশব্দে পাঠ করা :
গৃহে আপেক্ষিক বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান বেশি বেশি বই পাঠের সুযোগ করে দেয়। তবে এই পাঠ যে নিরিবিলিই হতে হবে তা জরুরি নয়। পঠন সামাজিক হতে পারে এবং ভাষার বিকাশে সাহায্য করতে পারে। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে অনলাইন লাইব্রেরি থেকে বই পড়ে শোনাতে পারেন কিংবা বাসার লাইব্রেরিতে থাকা পুরোনো কোনো ভুলে যাওয়া বই পড়তে পারেন। আপনি মৌখিক এবং লিখিত ভাষার বিভিন্ন তথ্য তাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন, তাদের বই এর সুপারিশ করতে পারেন এবং শিশুর বর্ণনামূলক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পঠনের সময় করা যায় এমন বয়স-উপযোগী প্রশ্ন সুপারিশ করতে পারেন। যেমনঃ শুরুতে কি হয়েছিল?’, ‘গল্পের মাঝে এবং শেষে কি হয়েছিল?’, মূল ঘটনা কি ছিল?’, ‘প্রত্যেক চরিত্রকে কি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো?’
সংযুক্ত থাকা :
এই সময়ে এসএলপিগণ বন্ধুদের এবং যৌথ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য জোড় দিতে পারেন না। সৌভাগ্যবশত অনেক পরিবারই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগৎ এ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারেন। ভাষাগত সীমাবদ্ধতাপূর্ণ শিশুরা ফোন এবং ভিডিও চ্যাটে যোগাযোগের বিষয়টির কৌশন সহজভাবে নাও বুঝতে পারে। তার সাথে প্রথমেই সুপারিশকৃত বিষয় এবং প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথোপকথনের মাধ্যমে অনুশীলন করে নিতে পারেন। যেমন, ”সেখানে আবহাওয়া কেমন? এখানে রোদ উঠেছে। আমার বাসায় থাকতে ভালো লাগে তবে আমি আমার বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর অভাব বোধ করছি।” যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাবিশিষ্ট শিশুদের সাহায্য করার জন্য তাদের ভাইবোনকে উদ্বুদ্ধ করুন।
পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া :
প্রাত্যহিক জীবনের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটলে আমরা সকলেই কম বেশি বিরক্তবোধ করি কিন্তু ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আছে এমন শিশুদের এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে সমস্যা হয়। এমনকি তারা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে সঙ্কটপূর্ন সময়ের কথা শুনে নিজেরা উদ্বিগ্ন হতে পারে। এছাড়াও তারা নিজেদের উদ্বেগের অনুভুতির কথা প্রকাশ করা, এটি নিয়ে কথা বলা, এই বিভ্রান্তিকর সময়ের ব্যাপারে টেলিযোগাযোগ সেশনে জিজ্ঞাসা করতে অপারগতা কিংবা অক্ষমতা অনুভব করতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি সহজ শব্দে তার জন্য এটি পরিষ্কার করে বোঝাতে পারেন যেমনঃ কোভিড-১৯, করোনাভাইরাস, সামাজিক দূরত্ব, কোরেন্টাইন, বাসায় অবস্থান করা এবং প্রাত্যহিক জীবনের পরিবর্তন সম্পর্কে তাকে বোঝাতে পারেন। পরিবারগুলোকে তাদের নতুন প্রাত্যহিক রুটিন তৈরীর করার জন্য এবং শিশুকে সিদ্ধান্ত নেয়ার অংশগ্রহণ করাতে উৎসাহিত করুন। উদাহরণস্বরুপঃ ‘তুমি কখন তোমার দাদীর সাথে কথা বলতে পছন্দ করবে?, আজ তোমার কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে চাও?, আজ কোন খাবারটি খেতে চাও?’
সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদান :
দুরে থেকেও শেখার ব্যবস্থা এবং অনলাইন ক্লাসগুলো ভীষণ চিন্তাকর্ষক এবং প্রশংসনীয় যা এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সৃজনশীলতা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার পরিচায়ক। আপনি যে শিশুটিকে সেবা দিচ্ছেন তার পরিবারকে শিশুর জন্য উপযোগী বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম খুজতে সাহায্য করতে পারেন। যদি আপনার ক্লায়েন্ট ইতিমধ্যেই প্রযুক্তির ব্যবহারকে উপভোগ করে তবে তাদের নিজের ভিডিও তৈরী, ডিজিটাল অংকন, তাদের দিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরী বই এবং কমিকের এপ ব্যবহার করতে বলতে পারেন। এরপর তাদের সেই উদ্ভাবনগুলো তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে বলতে পারেন।
শারীরিক ক্রিয়াকলাপ :
জীম, ব্যক্তিগত ক্রীড়াশিক্ষক, শারীরিক কসরতের বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমনঃ ”দ্যা নভেম্বর প্রজেক্ট” সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগের নতুন উপায় উদ্ভাবন করছে। ভাষাগত সীমাবদ্ধতাবিশিষ্ট শিশুদের সাথে এই ধরনের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করুন। কথোপকথনের বিভিন্ন বিষয় হিসেবে এগুলো নিয়ে আলোচনা করুন। যেমনঃ বিভিন্ন ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, সুস্থতার থাকার সাথে ভালো থাকার সম্পর্ক।
মানসিক অবস্থা :
আমাদের মধ্যে অনেকেই মানসিক চাপ কমানোর জন্য করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত বিভিন্ন ইতিবাচক পোস্ট শেয়ার করছি কিংবা অন্য কেউ আমাদের পাঠাচ্ছে। ভাষাগত অক্ষমতাবিশিষ্ট শিশুরা হয়তো এসব পোস্টের মর্মার্থ কিংবা মজার বিষয়টি বুঝতে পারবে না কারণ তারা স্বাভাবিক কথা এবং মজা করার জন্য বলা কথার সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝতে ব্যর্থ হয়। এগুলো বুঝতে আপনি তাদের সাহায্য করতে পারেন। অথবা তাদের জন্য সহজবোধ্য কোনো মজার গল্প পড়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
প্রতিদিনের ভাষা শিক্ষা :
ঘরে অবস্থান করে মানে প্রতিদিনই কিছু জিনিস অগোছালো করা এবং গোছানো। এগুলোকে ভাষা শেখানোর কাজে ব্যবহার করুন। যেমনঃ ‘কোন জিনিসগুলো একত্রে রাখা যায়?, তোমার কি মনে আছে কখন তুমি এই পোশাকটি পড়েছিলে?, তুমি কি এই খেলনাটি দিয়ে আর খেলবে? ‘
বর্ধনশীল এবং বিকল্প কথোপকথন ব্যবস্থা (এএসি) :
আপনি আপনার ক্লায়েন্ট, শিক্ষার্থী এবং শিশুর পরিবারকে বাড়িতে এএসি প্রক্রিয়ার ব্যবহার করতে বলতে পারেন। শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে নয় বরং তাদের এটা সবসময়ই ব্যবহার করা উচিত।
[ বর্তমান সময়ের প্রক্ষাপটে American Speech-Language-Hearing Association | ASHA থেকে প্রাপ্ত একটি আর্টিকেলের থেকে মূল্ভাবনা নেওয়া হয়েছে ]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী। নিজেকে উদ্যমী, সাহসী, স্বাধীনচেতা এবং সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি চেষ্টা করছি মানুষকে সচেতন করার।সমাজের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ড এবেইলজমের বিপরীতে তথাকথিত অক্ষম মানুষদের সক্ষমতার পরিচয় সকলের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবী এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।