“পটুয়াখালী জেলার কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক নবজাতকের মাথায় সুইচ-সার্কিট-পেঁচানো তার সংবলিত একটি যন্ত্র পাওয়া গেছে।”
উল্লেখিত শিরোনামটি তাজাখবর.কম এর ব্রেকিংনিউজ হলে আমাদের কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই কথাটি যদি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (MIT) একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক, অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোরিয়েট অধ্যাপক বলেন এবং তাও আবার যদি এভাবে বলেন যে, পৃথিবীতে যতো মানুষ জন্ম নিয়েছে, নিচ্ছে এবং নিবে সকল মানুষের অবস্থাই এমন। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটি অবশ্যই চিন্তা উদ্রেককারী।
এতক্ষণ বলা হচ্ছিলো বিশিষ্ট জ্ঞান-মনোবিজ্ঞানী (cognitive psychologist), সঞ্জননী ব্যকরনের (Generative linguistic) জনক, আমেরিকার বৈদেশিক নীতির কড়া সমালোচক, বহুশাস্ত্রীয় পন্ডিত প্রফেসর নো’ম চমস্কির ভাষা অর্জন যন্ত্র (Language Acquisition Device – LAD) অনুকল্পের (Hypothesis) কথা। আর এটিই ছিলো ব্যকরনের সঞ্জননী ধারার সূচনাকথা।
LAD অবশ্যই ধাতব তার সম্বলিত কোন সুইচের তৈরি না। হয়তো এটি মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ যা ভাষা অর্জন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। কিন্তু এর বাস্তবিক বাহ্যিক অস্তিত্ব চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। যন্ত্রের কাজের সাথে তুলনা করা যায় বলে এটিকে যন্ত্র (Device) নাম দেয়া হয়েছে। ভাষা অর্জন মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে গ্রথিত, এটি সহজাত(innate)। প্রতিটি স্বাভাবিক শিশু জন্মের সাথে প্রকৃতিপ্রদত্ত ভাষা অর্জন ক্ষমতা যন্ত্র (LAD) নিয়ে জন্মায়। এটির আছে দুটি অংশ, একটি অংশ সুইচ যা জন্মের পর কয়েক বছরের (০-৬) মধ্যে চালু করতে হয়, অর্থাৎ চমস্কির কথানুসারে জন্মের পর প্রথম কয়েক বছর যদি একটি মানবশিশু কোনো কথা না শিখে, মানুষের মুখে কোনো কথা না শুনে, মনুষ্যবিহীন কোনো পরিবেশে বাস করে তবে সে মানবভাষা শিখবেনা। এই কথার প্রমাণ ভিক্টর, জেনি নামক দুই জংলি বালকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, তাদের ভাষা শেখানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও তারা সঠিকভাবে ভাষা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি। উল্লেখ্য জন্মবধিররা ওষ্ঠ পাঠ (lip reading) পদ্ধতিতে কথা শিখতে পারেন।
যন্ত্রের আরেকটি অংশ যেটাকে কম্পিউটারের মাদারবোর্ড/CPU এর সাথে তুলনা করা চলে সেটা হলো সর্বজনীন ব্যকরন (Universal Grammar)। এটি সকল ভাষার সাধারন নিয়ম সংবলিত একটি জ্ঞান, যেটির কারনে অতিদ্রুত মানবশিশু তার মাতৃভাষা শিখতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য একটি শিশু যত সহজে তার প্রথম ভাষা শিখতে পারে দ্বিতীয় ভাষা শিখা তার জন্য ততটা সহজ নয়।
চমস্কি বলেছেন যে, LAD শুধুমাত্র মানবশিশুর মস্তিষ্কেই থাকে। ঠিক এই কারণেই মানুষের কাছাকাছি গঠনের প্রানী শিম্পাঞ্জিকে শত চেষ্টা করেও দুই একটি শব্দও শেখানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য শিম্পাঞ্জি সংকেত ভাষা (Sign Language) এর কয়েকটি সংকেত মনে রাখতে পারে। (Ref. The study of language; George Yule; Cambridge press)
১৯৬০ এর দশকে চমস্কি এ হাইপোসিস ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে অনেক ভাষাবিজ্ঞানী তার সাথে একমত পোষণ করেন যেমন এরিক লেনেবার্গ ১৯৬৭ সালে তার Biological Foundations of Language বইতে চমস্কির সাথে একমত পোষণ করেছেন। অনেক বিজ্ঞানী আবার চমস্কির সাথে একমত হননি যেমন বি. এফ. স্কিনার verbal behaviour নামক বইয়ে চমস্কির মতের ঘোর বিরোধিতা করেছেন।
শেষ করছি নো’ম চমস্কি সম্পর্কে বাংলাদেশের এক চিন্তক মুরাদুল ইসলামের একটি অসাধারণ মন্তব্য দিয়ে —
“যারা সক্রেটিসের সময়ে জন্মগ্রহণ করেননি বলে আফসোস করেন, তাদের উচিত সক্রেটিসের আমলের মানুষদের সাথে স্যার নো’ম চমস্কিকে নিয়ে গর্ব করা।”
তথ্যসূত্র:
2.Chomsky, (1959). A review of B. F. Skinner’s Verbal behavior. Language, 35, 26–58.
3.Chomsky, (1986). Knowledge of language: Its nature, origin, and use. New York: Praeger.
4.Lenneberg, (1967). Biological foundations of language. New York: Wiley.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।