প্রতিটি অশুদ্ধ এবং অপ্রমিত উচ্চারণ একেকটি প্রাকৃতিক উচ্চারণ – ভাষাবিজ্ঞানী ড. শিশির ভট্টাচার্য
উপরের কথাটিকে যদি একটু প্রলম্বিত করে বলা হয়- “প্রতিটি অপ্রমাণ (Nonstandard) যোগাযোগ ব্যবস্থাই একেকটি প্রাকৃতিক যোগাযোগব্যবস্থা” তবে তাকে ভুল বলা বোধহয় সমীচীন হবেনা। একজন মানুষ, যিনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত প্রমান নিয়মে যোগাযোগ করতে পারেন না, কোনো ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন না, কথা বলার দূর্বলতা অথবা কথাহীন। তাই বলে কি তিনি যোগাযোগই করতে পারেন না?
তিনি অবশ্যই নিজস্ব পদ্ধতিতে অন্য কোনো উপায়ে যোগাযোগ করে থাকেন। আমরা হয়তো তার প্রাকৃতিক যোগাযোগ পদ্ধতি বুঝতে অক্ষম, তাই নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করতে উল্টো তাদের কপালে জুড়ে দেই অক্ষম ট্যাগ। অক্ষমতা-সক্ষমতা নির্ণয়ের প্যারামিটার হলো প্রতিষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু বিজ্ঞজনেরা স্ট্যান্ডার্ড এর ইতিহাস তো এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে “দুর্বলের উপর সবলের সহজাত প্রবৃত্তি চাপিয়ে দেয়াই হলো প্রতিটি স্ট্যান্ডার্ড এর পেছনের ইতিহাস।”
আমরা যদি প্রকৃতিতে লক্ষ্য করি অসংখ্য যোগাযোগ পদ্ধতি দেখতে পাবো। ধরুন মৌমাছির যোগাযোগ পদ্ধতির কথা। মৌমাছিরা ওয়াগল ড্যান্স তথা ঘূর্ণণ নৃত্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে। তাদের নাচের পদ্ধতি, নৃত্য গোলক, নৃত্যপথের সীমা-কোনের পরিমাণ এবং নাচের পদ্ধতিই প্রকাশ করে কত কিলোমিটার দূরে কিংবা কোনপথে গেলে মধু- উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে। মৌমাছিরা সামাজিক জীব তাদেরও শৃঙ্খলিত সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান।
কল্পনা করতে পারেন, আরেকটি সামাজিক জীব পিঁপড়ার কথা। আমাদের পিঁপড়াদর্শনের একটি সাধারণ দৃশ্য হলো মার্চ করে এগিয়ে চলা একদল লাল পিঁপড়া। শৃঙ্খলা আর কর্মনিষ্ঠার উদাহরণে পিঁপড়ার নাম বলে দেয় আপামর জনতা। তারাওতো গড়ে তুলেছে এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে শব্দেতর তরঙ্গ এবং ফরমিক এসিডের গন্ধই যোগাযোগ প্রক্রিয়া।
ডলফিন একধরণের শব্দ তৈরি করতে পারে। একে ক্লিক সাউন্ড বলে। গভীর সমুদ্রে কাদাযুক্ত স্থানে যেখানে খুব অন্ধকার সেখানে ডলফিন এই সাউন্ড সৃষ্টি করে তার প্রতিধ্বনি শুনে অনুমান করতে পারে তার সামনে কোন বাঁধা আছে কি নেই। তারা এই শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কথা বিনিময় করে, ভাব বিনিময় করে, শিকার ধরার পরিকল্পনা করে, শত্রুকে ঘায়েল করার ছক তৈরি করে। কিছু কিছু ডলফিনের প্রজাতি সুর করে গান করতে পারে। ডলফিনরা খুব কেয়ারিং। যখন কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় সে সাহায্যে আবেদন করে ডাক দেয়। তার এই ডাক যারাই শুনতে পায় তারাই ছুটে আসে সাহায্য করার জন্য। যখন কোন ডলফিন আহত হয় বা অসুস্থ হয় তখন সঙ্গীরা তাকে ভেসে থাকতে সহায়তা করে যাতে সে ডুবে না যায়। এই সহযোগিতা অনেক ডলফিন মানুষকেও করেছে। এই ধরণের উদাহরণ আছে অনেক, জাহাজডুবির পর ডলফিনরা দলবেঁধে মানুষদের উদ্ধার করে পাড়ে তুলে দিয়েছে।
প্রকৃতিতে যদি অন্য ধরণের প্রাকৃতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেটা কি অপরাধ? যিনি কথা নয় বরং নিজের ভাব প্রকাশ করেন হাতের ইশারায় অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে অক্ষম বলা কি নির্বুদ্ধিতা নয়? আসুন মেনে নেই সকল প্রাকৃতিকতা। আমরা চেষ্টা করতে পারি তাদের ভাষা বুঝতে অথবা তাদেরকে সাহায্য করতে পারি আমাদের ভাষা বুঝাতে কিন্তু আমাদের ভাষা তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া মগের মুল্লুকের আইন বলেই গন্য হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।