প্রাচীনকালে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রে রোগীর রোগ বর্ননাই ছিলো একমাত্র উপায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক, প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস এর কাছে কোনো রোগী আসলে তিনি তাদের মূত্রের স্বাদ পরীক্ষা করতে রোগ নির্ণয় করতেন। অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের আগে হিপোক্রেটিস এর মূত্র স্বাদ পরীক্ষার মতো প্রাকৃতিক পরীক্ষার মাধ্যমেই চিকিৎকরা রোগ নির্ণয় করতেন। অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর শরীরের রক্ত, লালা, লসিকা, ত্বকের মধ্যে থাকা জীবাণু কিংবা অস্বাভাবিকতা চিকিৎসকদের দৃষ্টিগোচর হয়। তৎপরবর্তী চিকিৎসা প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলাফল আজকের রোগনির্ণয় পদ্ধতি। কেউ রোগাক্রান্ত হয়েছেন- এটি কেবলমাত্র তখনই বুঝতে পারেন যখন শারীরিক গঠন কিংবা শারীরিক প্রক্রিয়ায় কিছু অস্বাভাবিকতা বাহ্যিকভাবে অথবা অভ্যন্তরীণভাবে প্রকাশিত হয়। যেমন শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া শরীরে জীবাণু প্রবেশের লক্ষণ আবার রক্তে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা দ্বারা পর্যবেক্ষিত ম্যালেরিয়া জীবাণু কারো ম্যালেরিয়া রোগ হবার নির্দেশক। রোগলক্ষণ বা রোগ নির্দেশনার জন্য তিনটি শব্দ বহুল ব্যবহৃত হয়, আর তা হলো- সাইন, সিম্পটম ও সিন্ড্রোম। যদিও প্রত্যেকটিই রোগের বহিঃপ্রকাশ, পূর্বাভাস, রোগ নির্দেশক শারীরিক অস্বাভাবিকতা তবুও এদের মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান।
Symptom (রোগলক্ষণ)
শরীরের কোনো শারীরিক গঠন অথবা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন যা রোগী নিজে অনুভব করেন বা রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় রোগলক্ষণ বা সিম্পটম বলে ( Taber’s cyclopedic medical dictionary, 2005)। রোগী সাধারনত তার সিম্পটমস স্বজনদের কাছে বর্ননা করেন। এরকম কোনো রোগলক্ষণ অনুভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসকরাও রোগীর থেকে সিম্পটম জেনে রোগ সম্পর্কে একটি ধারণা নেবার চেষ্টা করেন। উদাহরণ হিসেবে মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, অসাড়তা, অবসাদ, কানে শো শো শব্দ শোনা, শরীরের কোথাও ব্যাথা এসব লক্ষণ কেবলমাত্র রোগীই অনুভব করতে পারেন। পরে রোগী চিকিৎসককে বলতে পারেন এবং চিকিৎসক লক্ষণ বিশ্লেষণ করতে পারেন। সাধারনত একটি সিম্পটমের তিনটি অংশ থাকে-
- Onset: কতদিন থেকে লক্ষণটি প্রকাশিত হচ্ছে, এটির প্রকৃতি কি হঠাৎ নাকি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই লক্ষণের সাথে অন্য কি কি লক্ষণ একসাথে দেখা গেছে এগুলো বিশ্লেষনই হলো Symptom Onset.
- Charecteristics: লক্ষণটি প্রকাশের অবস্থান মানে শরীরের কোন অঙ্গে প্রত্যঙ্গে লক্ষণটি প্রকাশিত হয়, এর তীব্রতা কেমন, কতক্ষণ ধরে এটি পরিলক্ষিত হয় আবার কি করলে তীব্রতা বাড়ে কিংবা হ্রাস পায়।
- Course since symptom: লক্ষণটির মাত্রা মানে এটি কত শতাংশ মানুষের মধ্যে দেখা যায়, এটি কোন রোগের উপসর্গ হিসেবে বেশি পরিচিত, উপস্থিত হালকা থেরাপি দিয়ে দেখা যে লক্ষণের কোনো পরিবর্তন হয় কিনা এসব বিশ্লেষণ করা হয় এই ধাপে।
সিম্পটম নিয়ে যে বিজ্ঞান আলোচনা করে তাকে Symptomatology বলে। সিম্পটম বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে যেমন: accessory symptom (এমন সিম্পটম যা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়), accidental (রোগের সাথে সঙ্গতিহীন কোনো লক্ষণ), alarming symptom (এমন উপসর্গ যাতে রোগীর মৃত্যুভয় থাকে যেমন- রক্ত পরা, মারাত্মক পানিশূন্যতা, অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া), pathogenic symptom (একেবারেই রোগ নির্দেশক লক্ষণ মানে এই লক্ষণটি প্রকাশিত হবার অর্থ ঐ নির্দিষ্ট রোগাক্রান্ত হওয়া) ইত্যাদি। এছাড়াও মোটাদাগে রোগলক্ষণকে তিনভাগে ভাগ করা যায়-
- Remitting symptom: এমন সিম্পটম যা ঝুঁকিহীন এবং এমনি অল্প কিছুদিনের মধ্যে চলে যায় যেমন: সর্দি,মাথা ভারী লাগা।
- Relapsing Symptom: বারবার প্রকাশিত সাধারণ লক্ষণ যা নির্দিষ্ট একটি রোগ নির্দেশক নয় যেমন: ডিপ্রেশন,অবসাদ ইত্যাদি।
- Chronic symptom: রোগ নির্দেশক সিম্পটম যা নির্দিষ্ট এবং কখনোই একেবারে দূর করা সম্ভব নয় যেমন: ডায়াবেটিস, এজমা সিম্পটম।
আবার অনেক সময় কিছু রোগের কোনো লক্ষণ কিংবা উপসর্গ প্রকাশিত হয়না এই অবস্থাকে asymptomatic condition বলে। বিভিন্ন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এরকম দশা লক্ষ করা যায়।
Sign (রোগ নির্দেশক)
রোগ নির্দেশক হলো রোগীর শরীরের প্রাণরাসায়নিক কিংবা ভৌত অবস্থার পরিবর্তন যা চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসা সম্পর্কিত কেউ রোগীর মধ্যে লক্ষ করেন। সাধারনত এটি যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে নিজ ইন্দ্রীয় দ্বারা সাইন বোঝার চেষ্টা ( হিপোক্রেটিস এর মূত্র স্বাদ পরীক্ষা) করলেও বর্তমানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক এর মাধ্যমে সাইন পরিলক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা হয়। স্টেথোস্কোপ,স্পাইরোমিটার, অপথালমোস্কোপ, স্ফিগমোম্যানোমিটার, এক্স রে ইমেজিং, আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং এরকম অনেক যন্ত্রকৌশল বর্তমানে রোগের সাইন বিশ্লেষণ করা হয়। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিপ্রবাহ, হৃদকম্পন মাত্রা, শারীরিক তাপমাত্রা, রক্তচাপ, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ইত্যাদি হলো গুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্দেশক (vital sign)। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সাইনকে প্রধানত চারভাগে ভাগ করা হয়-
- Prognostic Sign: যেসব সাইন রোগের পূর্বাভাস হিসেবে প্রকাশিত হয় বা রোগের ভবিষ্যত নির্দেশ করে , রোগের প্রকৃতি না বুঝিয়ে বরং রোগের তীব্রতা বোঝায় সেসব সাইন Prognostic Sign নামে পরিচিত।
- Anamnestic Sign: এসকল সাইন রোগের চিন্হ বা পুরোনো রোগের অবস্থা নির্দেশ করে যেমন শরীরে কোনো এন্টিভাইরাসের উপস্থিতি যা আগে কোনো রোগের কারণে প্রদান করা হয়েছিল।
- Diagnostic Sign: শরীরে বর্তমান অবস্থা যা রোগের নির্দেশক যেমন: শরীরে কোনো নির্দিষ্ট উপাদান (এন্টিজেন, হরমোন এবং অন্যান্য প্রাণরাসায়নিক উপাদান) এর পরিমাণ।
- Pathognomonic sign: কোনো নির্দিষ্ট রোগ নির্দেশক সাইন মানে এই সাইন মানে ঐ নির্দিষ্ট রোগ যেমন রক্তে HIV ভাইরাসের উপস্থিতি এইডস রোগ নির্দেশক।
Syndrome
Syndrome শব্দটির উৎপত্তি দুটি গ্রিক শব্দের সংমিশ্রণে, গ্রিক sun মানে হলো একসাথে এবং dranein মানে হলো দৌড়ানো কিন্তু এদের সংযোগে তৈরি Syndrome শব্দটি একসাথে কতগুলো লক্ষণের উপস্থিতিকে বুঝিয়ে থাকে। কতগুলো সাইন, সিম্পটম, পরীক্ষাগারের রিপোর্ট, শারীরিক ত্রুটি, প্রানরাসায়নিক সংযুক্তি, জেনেটিক কাঠামো যখন একটি শারীরিক অবস্থা তৈরি করে তাকে সিন্ড্রোম বলে। যেমন কারো খর্বাকৃতি, ছোটোগলা, দৃঢ় পেশি (rigid muscle) এরকম শারীরিক অবস্থা, কথা আটকে যাওয়া, কোনো কিছু শিখনে লম্বা সময় নেয়া, শারীরিক গঠন উন্নয়নে ধীরতা এরকম কতগুলো বাহ্যিক অবস্থা, শরীরে কিছু দরকারি হরমোনের অনুপস্থিতির মতো প্রাণরসায়নিক অবস্থা, ২১ নং ক্রোমোজমে একটি X ক্রোমোজের আধিক্য এরকম জেনেটিক অবস্থা এবং এক বিশেষ ধরণের মুখের গঠন ডাউন সিন্ডোম নামে অভিহিত করা হয়। এখানে কোনো কিছু শিখনে লম্বা সময় নেয়া, কোনো কিছু করতে গিয়ে হাতে পায়ে শক্তি কম পাওয়া যেমন সিম্পটম, শরীরে হরমোনের পরিমানের প্রাণরাসায়নিক অবস্থা সাইন এবং বিশেষ শারীরিক আকৃতি মিলে ডাউন নামে একটি সিন্ড্রোম তৈরি করেছে।
সর্বোপরি একলাইনে এভাবে ইতি টানা যায় যে , রোগীর দৃষ্টিকোণে রোগলক্ষণ হলো সিম্পটম, চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণে রোগ নির্দেশক হলো সাইন এবং সিন্ড্রোম হলো কতিপয় সাইন, সিম্পটম এবং শারীরিক অবস্থার সমস্টি।
তথ্যসূত্র:
1.Taber’s cyclopedic medical dictionary (2005)
2.Bangla academy dictionary (2010)
3.https://www.medicalnewstoday.com/articles/161858.php
4.https://www.verywellhealth.com/what-is-the-difference-between-signs-and-symptoms-1298941
5.https://www.medicinenet.com/symptoms_and_signs/symptomchecker.htm
6.http://www2.hawaii.edu/~heiby/overheads_classification.html
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।