শিশুর কথা বলতে শেখা: বাবা মায়ের করণীয়

American Speech Language And Hearing Association (ASHA) গবেষণা করে বয়সের সাথে মানবশিশুর কথা বলা, ভাষা উন্নয়ন ক্ষমতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পিতা-মাতার প্রতি করণীয় সম্পর্কে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। এই তালিকায় বয়সের উপর ভিত্তি করে কিছু কাজ শিশুর প্রতি যত্ন সহকারে করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

জন্ম থেকে দুই বছর:

  • শিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।
  • কথা বলার গতিকে শিশুর বোধগম্যতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধীর(Slow) করুন।
  • কথা বলার সময় এমনভাবে ঠোঁট নাড়ুন (Lipsing) যাতে শিশু আপনাকে অনুকরণ করতে পারে।
  • কথা বলার সময় স্বরের ওঠানামা করিয়ে শিশুকে স্বর পরিবর্তন শিক্ষা দিন।
  • শিশুকে বিভিন্ন গঠনের ধ্বনিগুচ্ছ যেমন স্বর+স্বর (আআ,ইই), স্বর+ ব্যাঞ্জন (আব), ব্যাঞ্জন+স্বর (মা,দা,বা), ব্যাঞ্জন-স্বর +ব্যাঞ্জন-স্বর (বা-বা, দা-দা,মা-মা) ধ্বনিত করতে শেখান।
  • শিশুর হাসি, মুখভঙ্গি (Facial Expression) নকল করে শিশুর কর্মকাণ্ড স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিন।
  • শিশুকে হাত তালি, চুমু ছুড়ে দেয়া (Flying Kiss), হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা যেমন ইকরি-মিকরি, পিক-আ-বু এরকম যৌথ কাজে উৎসাহিত করুন।
  • শিশুকে গোসল করানো, খাবার খাওয়ানো, পোশাক পরিধান করানোর সময় চুপ না থেকে শিশুর সাথে কথা বলুন।
  • রঙ পার্থক্যকরণ এবং গননা শেখানোর চেষ্টা করুন।
  • পশু পাখির ডাকের সাথে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিন‌। যেমন বাবু! জানো কাক কা…কা… করে ডাকে।
  • শিশুর যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করুন। শিশু একটি শব্দ বললে আপনি প্রসঙ্গ ঠিক রেখে বাক্যটি পূর্ণ করে দিন। যেমনঃ আপনি অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন আর আপনার শিশু বলে উঠলো “বাবা” আপনার স্ত্রী এবার বাচ্চার বলে ওঠা বাবা শব্দটিকে এভাবে পূর্ণ বাক্যে রূপান্তরিত করে দিতে পারে যে, “বাবু জিজ্ঞেস করেছে যে বাবা এসেছে কিনা?” আর আপনি উত্তর করতে পারেন “হ্যাঁ বাবাতো অফিস থেকে বাসায় এসে গেছে।”
  • শিশুর নাম ধরে ডাকুন।
  • কথা বলার সময় হাত নাড়িয়ে, মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে শিশুকে অবাচনিক যোগাযোগের (Non-Verbal Communication) সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।

 

দুই থেকে চার বছর:

  • শিশুর সামনে স্পষ্ট এবং স্বাভাবিক গতিতে কথা বলুন।
  • শিশুর বলা শব্দকে বারবার পুনরাবৃত্তি করে শব্দ আয়ত্ত করতে সহায়তা করুন। যেমনঃ আপনার শিশু বললো শরবত। আপনি বলতে শুরু করেন যে “হ্যাঁ বাবু এখন শরবত খাবে”, “বাবু আর আমি এখন লেবু চিনি গ্লাসে নিয়ে শরবত বানাবো‌ তারপর আমার শরবত খাবো‌।”
  • বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সময় শিশুকথা(Baby Talk) এবং স্বাভাবিক কথার মিশ্রণে কথা বলুন। যেমন চলো ঘুমাতে যাই বলার পরিবর্তে 

 

“ডিং ডিং ঘন্টা বাজছে,
পাখিরা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে,
বাবুর ঘুমের সময় হয়েছে,
চলো বাবা ঘুমাতে যাই।”
     

                        এভাবে বলুন।

 

  •  স্ক্রাপবুক, প্লেকার্ড বানিয়ে বাচ্চাদের মজার সাথে ভাষা শেখানো যায়। পত্রিকা, বিভিন্ন বই থেকে ছবি কেটে অথবা ছবি প্রিন্ট করে এগুলো তৈরি করা যায়।
  • .খেলতে খেলতে শিশুকে প্রশ্নোত্তর শেখান। যেমন, “গরু কি আকাশে ওড়ে?না গরু আকাশে ওড়ে না।”
  • সবসময় একাধিক বিকল্প উপস্থাপন করে তুলনা করে বাছার সুযোগ দিন। যেমনঃ “তুমি কি এখন দুধ খাবে নাকি ফলের রস? লাল নাকি নীল কোন পোশাকটি পরতে চাও?”
  • .সুরে সুরে শিশুতোষ ছড়া ছন্দ কবিতা শেখান।
  • .পরিচিত মানুষদের ছবি দেখিয়ে নাম বলে তাদের চিনতে শেখান।

 

চার থেকে ছয় বছর:

  • .যখন শিশু আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চায় তখন তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিন‌ এবং আপনি কথা বলার সময় আপনার প্রতি শিশুর মনোযোগ নিশ্চিত করুন।
  • স্বীকৃতি, অনুমতি, নিয়মনীতি, প্রশংসা, নিন্দা প্রভৃতি শিক্ষা দিন। ভালো কাজের প্রশংসা করে উৎসাহ দিন এবং খারাপ কজের জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করুন।
  • .কথা বলার মাঝে থামুন। শিশুকে কথা গুছিয়ে নিতে এবং তার গতিতে কথা বলার সুযোগ দিন।
  • শব্দভান্ডার বৃদ্ধির জন্য শিশুর হাতে তুলে দিতে পারেন শব্দ শেখার বই।
  • শিশুর সাথে কথা বলার সময় পূর্ণ প্রসঙ্গ বুঝিয়ে দিন যাতে শিশুর বোধবৃদ্ধি ঘটে (Cognition Enhancement)।।যেমনঃ আমি ক্লান্ত না বলে আমি সারাদিন কাজ করেছি তাই আমি ক্লান্ত বলার অভ্যাস করুন।
  • উপর-নিচ, ডান-বাম, ছোট-বড়, প্রথম-মধ্যম-নিম্ন এরকম বিপরীতার্থক সম্পর্ক বিষয়ক শিক্ষা দিন।
  • ইঙ্গিত দিয়ে শেখান। যেমনঃ কুকুরের ইংরেজি এমন একটি শব্দ যার প্রথম বর্ণ হলো D, বলোতো কুকুর ইংরেজি কি?
  • শ্রেনিবিন্যাস, শ্রেণীসজ্জা শেখান। যেমনঃ গ্লাসের সারিতে শুধু গ্লাস থাকে সেখানে প্লেট থাকবে না। জুতার টেবিলে জুতা থাকবে নিশ্চয়ই তা পড়ার টেবিলে নয়।
  • দুই তিন পর্বের (Step) নির্দেশনা দিন। যেমনঃ ওই রুমে যাও,
    টেবিলের উপর ওঠো,
    কলম নিয়ে আসো।
  • বুদ্ধিবৃত্তিক খেলায় উৎসাহিত করুন যেমনঃ ঘর বানানো, ছবি আঁকা।
  • টেলিভিশন, পত্রিকা ইত্যাদি থেকেও ভাষা শেখানো যেতে পারে।
  • .সারাদিনের কাজগুলোর সারাংশ গল্পাকারে বলতে উৎসাহিত করুন। যেমনঃ সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে নাস্তা করেছিলাম। তারপর মেরুন রঙের পোশাক পরে মায়ের সাথে স্কুলে গিয়েছিলাম……………….. এখন আবার মায়ের সাথে ঘুমাতে এসেছি।
  • বাজার করা, উপসানলয়ে গমন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সময় আপনার শিশুকে সাথে রাখুন এতে শিশু সামাজিক ভাষা শিখতে সক্ষম হবে।

লেখাটি American Speech Language And Hearing Association এর একটি গবেষণাপত্রের সুপারিশ ছকের ভাবানুবাদ। 

Leave a Comment

Skip to content