মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের একটি কান। কানের প্রধান কাজ দুটি এক. শ্রবন, দুই. দেহের ভারসাম্য রক্ষা। কানের বিভিন্ন রোগের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত রোগটি কানে পানি।
কান সম্পর্কিত রোগসমূহকে অটোল্যারিংগোলজির ভাষায় ওটাইটিস (Otitis) বলে। কানে পানি কোনো অনুজীব ( S. pneumoniae, H. influenzae, M. Catarrhalis) সংক্রমনেও হতে পারে আবার অংসক্রামক পানিও জমতে পারে। সংক্রামক পানি জমলে অনেক ব্যাথা হয় যা সহজেই অনুমেয় এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু অসংক্রামক পানি (Otitis media with effusion) বেশিরভাগ সময়েই কোনো লক্ষণ প্রকাশ করেনা- যা একটি শিশুর বিকাশ সময় বা ভাষিক গুরুত্বপূর্ণ সময় (জন্ম থেকে ৫ বছরের) মাঝে বারবার হলে ঐ শিশুটির ভাষা ও বাচন বিকাশে (Speech & language development) একটি মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কানে এই অসংক্রামক পানি কেনো জমে? এর উত্তরে সবচেয়ে বড় কারন হলো ইউস্টেশিয়ান টিউব এর অকার্যকারিতা। ইউস্টেশিয়ান টিউব মধ্যকর্নের একটি অংশ যেটি কান এবং নাসা-গলবিল (নাক গলবিলের যেখানে উন্মুক্ত হয়) এই দুই পয়েন্টকে সংযুক্ত করে। এটির প্রধান কাজ হলো কানের গহ্বরে চাপের ভারসাম্য রক্ষা। এর সাথে কানে পানি বা অতিরিক্ত মিউকাস থাকলে তাও বাতাসের সাথে কান থেকে নাকের দিকে সরিয়ে নেয়াও এই টিউবের একটি কাজ। কিন্তু যখন ইউস্টেশিয়ান টিউব এই কাজটি সক্ষমতার সাথে করতে পারেনা বা ইউস্টেশিয়ান টিউব কোনো কিছু দিয়ে বন্ধ হয়ে থাকে তখন কানে অংক্রামক পানি জমা একটি সাধারণ ফলাফল।
শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয় কারণ শিশুদের এই টিউব কিছুটা সমতল থাকে যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটু হেলানো বক্রতলে পরিনত হয়। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে কানে অসংক্রামক পানি জমা একটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা যারা শারীরিক (যেমন-সেরেব্রাল পালসি, ঠোঁট কাটা, তালু কাটা) অথবা মস্তিষ্ক বিকাশজনিত (অটিজম, ডাউন সিন্ড্রোম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা) সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
আপনি কি করে বুঝবেন যে আপনার শিশুটির কানে অংক্রামক পানি জমেছে? আসলে আপনি খুব সম্ভবত বাইরে থেকে দেখে বুঝতেই পারবেন না কারণ বেশিরভাগ সময়েই এটি কোনো লক্ষণ প্রকাশ করেনা। তবে কান ভারী ভারী লাগা, ডাকে সাড়া কম দেয়া, ঘুমে ব্যাঘাত, শিশুকে কানে বারবার হাত দিতে দেখা অথবা যেহেতু শিশু কানে কম শুনতে পাবে তাই বিভিন্ন আচরণগত পরিবর্তনও প্রকাশ পেতে পারে – এমন কিছু লক্ষ্য করলে একজন অডিওলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করুন। তিনি কানের মধ্যে অটোস্কোপিক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে পারবেন কানে কোনো সংক্রামক অথবা অসংক্রামক পানি জমেছে কিনা।
কানে অসংক্রামক পানি জমলে তার চিকিৎসা কি? প্রথমত অডিওলজিস্ট সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন অর্থাৎ কয়েকসপ্তাহ কানের অবস্থা নিয়মিত দেখবেন। সাধারণত অধিকাংশ অংসক্রামক পানি এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। এরপর যদি এটি বারবার হয় তখন তা উদ্বেগের বিষয় হয়। তখন অডিওলজিস্ট আপনাকে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করবেন। ডাক্তার আপনাকে প্রথমত ওষুধ দিবেন। তারপর প্রয়োজনে টিমপানোপ্লাস্টোমি টিউব নামে একটি টিউব সার্জারির মাধ্যমে কানের পর্দায় (Tympanic membrane) স্থাপন করে দিবেন চিকিৎসক যেটি একটি ইউস্টেশিয়ান টিউব এর কাজ করবে। অপারেশন শেষে আবার অডিওলজিস্টের কাছে হিয়ারিং রিহ্যাবিলেটশন এর জন্য পরামর্শ নিতে হবে।
যেহেতু কানে অংসক্রামক পানি এমনিতেই ঠিক হয়ে যায় সুতরাং এটা নিয়ে চিন্তিত হবার কারণ আছে কিনা? যদি একবার হয় তবে চিন্তিত হবার কারণ নেই কিন্তু যদি কিছুদিন পর পর ফিরে আসে তবে উদ্বেগের কথা। আর যদি ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হয় তবে যতদ্রুত সম্ভব অডিওলজিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত।
আমরা জানি বাচন ভাষা বিকাশ কানে শোনার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সবগুলো ধ্বনি সচেতনতা (Phonological awareness), শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ এসব প্রক্রিয়া শ্রবন চ্যানেলেই বেশিরভাগ সম্পন্ন হয়। এছাড়া ভাষা অনুধাবন ক্ষমতা হলো ভাষা প্রকাশ ক্ষমতার পূর্বসুরী। সুতরাং বারবার কানে পানি জমার কারনে যদি শিশুর ভাষা আয়ত্বকরন পর্যায়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এটি তার পরবর্তী ভাষা ব্যবহার, অনুধাবন, পঠন লিখনসহ জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং শিশুর কানের ব্যাপারে যত্নবান হোন যদি কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় বা আপনি সন্দেহ করেন যতদ্রুত সম্ভব শ্রবনচিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।