আজ থেকে ছয়মাস আগে আমরা যেমন ছিলাম আজ আর তেমন নেই। বিদ্যমান মানবসমাজ এবং সভ্যতা নতুন সংজ্ঞায়নের মুখোমুখি।বানিজ্যিক, রাজনৈতিক , শিক্ষাসহ সকল সামাজিক কাঠামোসমূহ সম্পূর্ণ এক নতুন এবং অভিযোজিত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পরিচালনার প্রয়াস চলমান। সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা যখন নোবেল করোনা ভাইরাসের আক্রমনের সাথে লড়াই করছে একই সমান্তরালে আমরা ঘরবন্দি মানুষ এক অদেখা মানসিক চাপ সামলানোর যুদ্ধে লিপ্ত। আমরা জানি যারা আমাদের মধ্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ তাদের সবসময়েই একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় এবং সেটির প্রয়োজনীয়তা এখন পূর্বের তুলনায় আরো বেশি। চলমান এ সামাজিক এবং মানসিক লকডাউন যতই সামনে এগোবে ততোই বিশেষ যত্নের পরিমাণ ততোধিক বেশি প্রয়োজন হবে। এমন অবস্থায় আমাদের অর্থাৎ যেসব পরিবারে এমন মানুষ আছেন যারা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন তাদের করণীয় কি?
এ বিষয়ে নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের Frank Porter Graham Child Development Institute এর গবেষকরা পূর্ববর্তী গবেষকদের “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ” বিষয়ক গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি স্ট্রাটেজি মডেল প্রস্তাব করেছেন। এই মডেলটি অটিজম বৈশিষ্ট্য উপস্থিত এমন শিশুদের জন্য প্রস্তাবিত তবে এর থেকে অন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্নদের যত্নেরও একটি দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এখানে ৭ টি পয়েন্টে বিশেষ যত্নের কথা বলা হয়েছে।
১. বুঝতে সহায়তা করা: অটিজম বৈশিষ্ট্য আছে এমন মানুষদের সাধারনীকরন (Generalization) এবং অনুধাবনে প্রায়শই সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। তাই তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সবার মতো বুঝে ফেলার প্রবণতাও কম দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এখানে আমরা যা করতে পারি-
- ভাইরাস সংক্রমণ, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন এসব উদ্ভূত বিষয়সমূহ বিমূর্ত পরাবাস্তবভাবে না বলে বাস্তব, ইন্দ্রীয় দিয়ে অনুভব করা যায় এমন কিছু উদাহরনের সাহায্যে বোঝান। “অমুক করোনা ভাইরাস সংক্রমিত”, “এখন লকডাউন” এরকম না বলে এভাবে বলুন- “করোনা একধরনের জীবাণু, এটি খুবই ছোটো তাই চোখে দেখা যায় না, এটি যে মানুষের শরীরে ঢুকে তার মাধ্যমে তোমার শরীরেও আসতে পারে। তাই তুমি অন্য একজন মানুষ থেকে দুইহাত দূরে অবস্থান করবে। এটি মুখ চোখ নাক দিয়ে ঢুকে পরে তাই এসব জায়গায় হাত দেয়া যাবেনা। এটি তোমার শরীরে ঢুকলে তুমিও অসুস্থ হয়ে যাবে।”
- যদি সম্ভব হয় গল্প বা ছড়ার মাধ্যমে এসব তথ্যসমূহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কাছে পৌছান।
- শুধু মাত্র কথা না বরং লিখে এবং চিত্র দিয়ে বুঝান। কারণ অটিজম আক্রান্তরা দেখে বেশি শিখে। তাই দরকারি বিষয়সমূহ বিভিন্ন চিত্র বা ডায়াগ্রাম দিয়ে বুঝান। যেমন হাত ধোয়ার স্টেপ বাই স্টেপ ডায়াগ্রাম হতে পারে এমন- https://bit.ly/3e3e4nd
২. অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দেয়া: আমরা জানি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের সামাজিক যোগাযোগ কিংবা অনুভূতি প্রকাশের দিক থেকে একটি চ্যালেন্জ থাকে। এটি তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তাই এই সময়ে আপনার পরিবারের বিশেষ মানুষটির অনূভুতি প্রকাশের সুযোগ দিন। একটু মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন। শুধু কথার মাধ্যমে না ডিজিটাল প্রযুক্তি, লেখা , চিত্র বিভিন্ন উপায় তার হাতে তুলে দিন তাকে যাতে ভাব প্রকাশে অধিকতর সুবিধা পায়।
৩. আগ্রহকে কাজে লাগানো: অটিজম আক্রান্ত মানুষদের বিশেষ কোনো বস্তু বা কাজের উপর অতিরিক্ত আগ্রহ থাকে। এই বিশেষ আগ্রহটি সাধারণত তাদের নিজেকে শান্ত কিংবা মানসিক চাপ সামলাতে সাহায্য করে। ধরুন কেউ হ্যান্ড ফ্লাপিং করে। এটি তার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেবার একটি কৌশল। এরকম কাজ বা বস্তুসমূহের তালিকা করুন এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের ফাঁকে ফাঁকে এগুলো প্রনোদনা/ পুরষ্কার হিসেবে তাকে করতে দিন।
অবশ্যই বিশেষ মানুষটিকে নিয়ে কিছু শারীরিক ব্যায়াম নিয়মিত করবেন। এটিও তাকে মানসিক চাপ মুক্ত রেখে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
৪. রুটিন অনুসরণ: অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের যেহেতু নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত আচরণ (Restricted behaviour) পছন্দ। তাই একটি নির্দিষ্ট রুটিন ব্যবহার করুন। যেটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি স্থান পাবে তা হলো খাবার এবং ঘুমের চক্র ঠিক রাখা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া, জেগে উঠা ঠিক রাখার চেষ্টা করুন।
৫.নতুন রুটিন তৈরি: আগে যে রুটিনটি মেনে আপনি বিশেষ মানুষটির যত্ন নিতেন। সেটিতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেমন এখন স্কুল বন্ধ তাই নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল যাওয়া হয়না। থেরাপি সেন্টারে যাবার সুযোগ নেই। আগের রুটিনের অনেকগুলো কাজ এখন নেই এবং নতুন কিছুও যোগ হয়েছে। এ সময়ে যেসব ব্যাপারে বিশেষভাবে খেয়াল করবেন-
- তাকে পছন্দ করার সুযোগ দিন। যেমন এখন বাংলা লিখবে তা না বলে বাংলা নাকি ইংরেজি কোনটি লিখবে- এভাবে বলুন। ভাত খাও- না বলে তুমি কি এখন ভাত খাবে নাকি পাঁচ মিনিট পরে খাবে – এভাবে পছন্দকরে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিন।
- এখন যেহেতু বাইরে বিনোদনের সুযোগ নেই তাই বেশিরভাগ সময়েই প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের সুযোগ নিতে হচ্ছে আমাদের। তাই এখানে সতর্কতা অবলম্বন করুন। টিভি দেখা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কিংবা অন্য কোনো বিনোদনমূলক কাজের সময় বেধে দিন এবং সময় মুখে না বলে ভিজ্যুয়াল টাইমার, স্টপওয়াচ, রিমাইন্ডার এসব ব্যবহার করুন।
৬. দূর থেকে যোগাযোগ: এখন যেহেতু স্কুলে অংশগ্রহণ কিংবা বাইরে কারো সাথে দেখা করার সুযোগ নেই তাই যাতে একঘেয়েমি না চলে আসে এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা পরিচালনা করা যায়। তাই যথাসম্ভব অডিও এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখুন। অনেক বিশেষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক স্কুল ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করছে তাতে অংশগ্রহণ করুন। থেরাপি সেবা নিতে টেলিথেরাপির শরণাপন্ন হন। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ কথাবন্ধু নামে প্লাটফর্মের মাধ্যমে ফ্রি স্পিচ থেরাপি দিচ্ছে টেলিথেরাপি ফরম্যাটে – এসব সেবা গ্রহণ করুন।
www.facebook.com/kothabondhuDU
৭.আচরণ বা ব্যবহার পরিবর্তন: এতো দিন বাসায় অবস্থান এবং আগের দৈনিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আরোপ হওয়ায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষটির মাঝে মানসিক চাপ, আচরণ এবং ব্যবহার পরিবর্তন এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এসব মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করুন। টেলিফোনে থেরাপিস্ট অথবা যেখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহন করতেন সেখান থেকে সেবা নিন দরকারে থেরাপিস্ট, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।