স্কুলে যাওয়ার আগেই ছোট্ট একটা মেয়ে মা- মাসির সাথে গল্প করতে করতেই লেখা পড়তে শিখে গেলো। ভাবছেন, এ আবার কিভাবে সম্ভব? বই খাতা নিয়ে মাস্টারের কাছে না বসে, স্কুলে না গিয়ে কিভাবে কেউ কোনো লেখা পড়তে শিখে ফেলে? আমার রঙিন শৈশবের বিচিত্র সেই গল্পই আজ শুনাবো আপনাদের।

বয়স তখন মাত্র আড়াই কি তিন হবে হয়ত। বাবা অফিস চলে যাওয়ার পর সারাদিন পুতুল খেলা আর মাকে বিরক্ত করা ছাড়া বিশেষ কোনো কাজ ছিলনা তখন। খেলার ছলেই মায়ের কাছে অক্ষর চেনার পরই মা এর ওড়না পেচিয়ে শাড়ি বানিয়ে, বগলে মোটা তাজা এক বই নিয়ে সারাদিন মাকে বলতাম “ভাবি বিসিএস পরীক্ষা দিতে যাই।”

বাবা অফিস চলে যাওয়ার পর পাশের বাসার আন্টির ঘরে বসত গল্পের আসর। (হাল ফ্যাশনের আঁতকে ওঠার মত কুটবুদ্ধিসম্পন্য “পাশের বাসার আন্টি” না। বরং, এই আন্টি ছিলেন আমার মায়ের ই আরেক রূপ, এখনও যিনি আমার কাছে পরম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মমতাময়ী এক নারী)

মা- আন্টির গল্পের গভীর শানে নুযুল উদ্ধার করতে না পেরে একরকম বিরক্ত হয়েই ছোট্ট আমি একদিন সামনে থাকা খবরের কাগজটা হাতে নিলাম। মা এর কাছে বর্ণমালা- তালিমের সুবাদে তখন অক্ষর চিনতে পারি ভালোই, উচ্চারণ আধো আধো। সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারণে পড়তে শুরু করলাম প্রথম আলো দৈনিকের বড়ো বড়ো শিরোনামগুলো।

গল্পে মগ্ন মা – আন্টির চোখে ব্যাপারটি ধরা পড়লো বেশ কিছুদিন পর, যখন পেপার পড়া আমার অভিমান থেকে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি আমার ভাঙ্গা উচ্চারণে পেপার রিডিং পড়তে পারি দেখার পর মা এবং আন্টি বেশ নড়ে চড়ে বসলেন। কাগজের শিরোনাম থেকে ধীরে ধীরে পড়তে শিখলাম ছোট ছোট কলাম, প্রথম আলোর “বেসিক আলী” কমিকস, “বিলিভ ইট অর নট” এবং বিভিন্ন ধাঁধা। অবশ্য পড়ার গতি বেগবান হওয়ার পেছনে আরেকটি ব্যাপার ছিল। ঐযে “ভাবি বিসিএস দিতে যাই” খেলা? লোভ দেখানো হলো, যত দ্রুত পড়তে পারবো, বিসিএস হবে তত ভালো! আমাকে আর ঠেকায় কে!

সেই থেকে শুরু হলো আমার পড়তে পারার পথচলা। জীবনের নানা জটিলতা – যান্ত্রিকতায়, হাজার অভিজ্ঞতার ভিড়ে শৈশবের বেশ কিছু স্মৃতিতে ধুলো পড়লেও এই হাতেখড়ির স্মৃতিতে এতটুকুও আঁচ লাগতে দেইনি। সযত্নে সোনা- মুড়িয়ে রেখেছি হৃদয় সিন্দুকে।

এমন সুখের স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ কি জীবন বারবার উপহার দেয়?

Leave a Comment

Skip to content