টরেট সিন্ড্রোম

টরেট সিন্ড্রোম এমন একটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত রোগ যার কারণে কোন একজনেরশরীরের এক বা একাধিক অংশ (হাত, পা, কাঁধ,ঠোঁট, ভুরু, এমনকি ভোকাল কর্ডইত্যাদি) অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্বয়ংক্রিয় এবং পুনঃপুন সাড়া প্রদান করে। ৩-৯ বছরের মধ্যেই সাধারণত এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। 

টরেট সিনড্রোম এক ধরণের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। এটি ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম চিহ্নিত করেন ফরাসি বিজ্ঞানী ডক্টর জর্জেস গিলেস ডে লা টরেট। ৮৬ বছর বয়সী একজন ফরাসি মহিলার মাঝে এটি পরিলক্ষিত হয়। নিউরো মানে মস্তিষ্ক, ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার দ্বারা বুঝানো হয় শিশুর বিকাশের সময় উদ্ভূত কোন সমস্যার কারণে যে সকল রোগের সূচনা হয় এবং যার ফলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে ত্রুটি রয়ে যায়। শিশুর বিকাশের (শিশু ভ্রুণ অবস্থায়, এবং জন্মের পরে কয়েক বছরের মাঝে যে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো রয়েছে) সময় মস্তিষ্ক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে নিউরো  ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার ধরা হয়। নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার আবার বিভিন্ন কারণে হতে পারে। জ্বিনগত ত্রুটির কারণে, বংশপরম্পরায়, শিশুর মেনিনজাইটিস হলে, গর্ভাবস্থায় মায়ের অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপানের কারণে, মস্তিষ্কের অন্য কোন ট্রমার কারণে অথবা আরো অনেক কারণ যা এখনো নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি।

টরেট সিন্ড্রোম সাধারণত ইনহেরিটেন্টলি (বংশ পরম্পরায়) প্রবাহিত হয়। কোন বাচ্চার বাবা বা মায়ের টরেট থাকলে সন্তানের টরেট হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। টরেটের সকল কারণ এখনো নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে মেয়েদের থেকে ছেলেদের মাঝে ৩/৪ গুণ বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্রেইনের নির্দিষ্ট কিছু অংশ (ব্যাসাল গ্যাংলিয়া, ফ্রন্টাল লোব এবং কর্টেক্স) এই সকল অংশকে সংযুক্তকারী সার্কিট, এবং নিউরোট্রান্সমিটারগুলো (ডোপামিন, সেরোটোনিন এবং নোরপিনেফ্রিন) যা স্নায়ু কোষের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করে এদের অসামঞ্জস্যই টরেটের জন্যে দায়ী। টরেট সিনড্রোমের তীব্রতার মাত্রারও বৈচিত্র রয়েছে।

টরেট সিনড্রোমকে বুঝতে হলে সর্বপ্রথম বুঝতে হবে টিকস কী? এবং কত প্রকার? টরেট সিন্ড্রোমের দুই ধরণের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। এগুলোকেই টিকস বলা হয়।

 ফোনিক টিকঃ স্বয়ংক্রিয় রেসপন্সের কারণে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ভোকাল কর্ড দিয়ে কোন শব্দ করা, চিৎকার করা, গালি দেওয়া (coprolalia) অথবা কোন ফ্রেজ আওড়ানো এবং কথা বা কাজের মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই বার বার সেই আওয়াজ করতে থাকা বা বলতে থাকা।

 মটর টিকঃ স্বয়ংক্রিয় রেসপন্সের কারণে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে হাত পা নাড়ানো, ঘাড় ঝাড়া দেওয়া, মুখ বাকানো, ভুরু কোচকানো, লাফ দেয়া, হাত পা ছোড়া, নিজের বা অন্য কারো গায়ে ঘুষি বা লাথি মারা ইত্যাদি।

টিকগুলোকে আরো দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

 সিম্পল টিকঃ যে টিকগুলো এক সেকেন্ডেরও কম সময় স্থায়ী হয় এবং সহজে চোখে পড়ে না সেগুলো সিম্পল টিক। যেমনঃ ঘন ঘন চোখের পলক ফেলা, নাক দিয়ে শব্দ করা, মাথা ঝাকানো ইত্যাদি।

 কমপ্লেক্স টিকঃ যে টিকগুলো সিম্পল টিক থেকে স্থায়ী হয় এবং অস্বাভাবিক আচরণ হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করা যায় সেগুলো কমপ্লেক্স টিক। যেমনঃ কথার মাঝে কোন শব্দ বা ফ্রেইজ বার বার আওড়াতে থাকা, হাত পা ছোঁড়া, লাফানো ইত্যাদি।

সাধারণত আক্রান্তের মাঝে মটর এবং ফোনিক দুই ধরণের টিকসই দেখা যায়। তবে এই টিকগুলো অন্যান্য কারণেও হতে পারে।

তাই যদি টানা এক বছর টিকস না দেখা যায় অথবা টিক শুরু হওয়ার পর টানা তিন মাস বন্ধ থাকে তাহলে টরেট সিনড্রোম ব্যাতীত অন্য কিছুও হতে পারে।টরেট অবশ্যই ১৮ বছর বয়সের আগে প্রকাশ পাবে। সিম্পল টিক আগে এবং কমপ্লেক্স টিক পরে উদ্ভূত হবে। এর ব্যতিক্রম হলে (কমপ্লেক্স টিক আগে তৈরি হলে) এটি টরেট না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

উত্তেজিত হলে টিকস বেশি দেখা যায়। শান্ত, মনোযোগী হলে তুলনামূলক কম হয়। নিজের বা অন্যের কোন বিশেষ কাজ টিকস এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন টাইট জামা পরলে বার বার কাঁধ ঝাকানো, কিংবা কাউকে গলা খাকাড়ি দিয়ে শব্দ করতে দেখলে অনিচ্ছাকৃত ভাবে নিজেও বার বার করতে থাকে।

টিকস হঠাৎ এসে আবার হঠাৎ চলে যেতে পারে৷ সময়, বয়স এবং স্থানের ভিত্তিতে টিকস পরিবর্তন হতে পারে এবং তীব্রতাও বাড়তে কমতে পারে। একজন সাধারণত বয়ঃসন্ধির মাঝামাঝি সময়ে বেশি টিকসের শিকার হয়। তবে বয়স বাড়লে এটা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে।

কোন একটি ডিসঅর্ডারের কারণে উদ্ভূত আরো কয়েকটি সমস্যা হলো এসোসিয়েটেড ডিসঅর্ডার। টরেট সিন্ড্রোমের কারণে উদ্ভূত টিকসের থেকে অনেক সময় এর এসোসিয়েটেড ডিসঅর্ডারগুলো বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। টরেট হলে ADHD( Attention Deficit Hyperactivity Disorder) এবং OCD (Obsessive Compulsive Disorder) হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। ধারণা করা হয় যে ৫০/৬০% টরেট আক্রান্তের উপরের দুইটি এসোসিয়েটেড ডিসঅর্ডার হতে পারে। এছাড়া Depression, Anxiety, Writing or Reading Disability তৈরি হতে পারে। তবে টরেটের কারণে বুদ্ধিমত্তা বা সৃজনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। শিশুরা সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয় বলে অন্য শিশুদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চায়৷ এগুলোর সাথে টরেটের সরাসরি কোন সংযোগ নেই।

টরেট থেকে একেবারে মুক্তি পাওয়ার মতো কোন চিকিৎসা এখনো তৈরি হয়নি। থেরাপি বা নিজের চেষ্টার মাধ্যমে মনোযোগ সরিয়ে টিক সাপ্রেস করা যায়। এছাড়া কিছু নিউরোলেপ্টিক মেডিসিন যেমনঃ (haloperidol and pimozide) ব্যবহার করেও টিক সাপ্রেস করা যায়। এগুলো একই সাথে ADHD এবং OCD এর ক্ষেত্রেও কাজ করে। তবে এইসব মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে তাই প্রফেশনালের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা উচিৎ নয়। এছাড়া কোন অঙ্গে টিকের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে সেখানে botox ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেও টিক সাপ্রেস করা যায়।

এছাড়া এক ধরণের Deep Brain Stimuation Surgery এর মাধ্যমে ব্যাসাল গ্যাংলিয়ায় ইলোক্ট্রোড বসিয়ে টরেট থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে মতামত দেন না। কারণ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সফলতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

নোট ১: টরেটে আক্রান্তরা টিকগুলো ইচ্ছে করে করে না।

নোট ২:মনোযোগ সরিয়ে বা অন্য কিছু চিন্তা করে টিক সাপ্রেস করা যায়। কিন্তু এতে
করে এংজাইটি বাড়তে থাকে।

তথ্যসূত্র:
1. https://www.ninds.nih.gov/disorders/patient-caregiver-education/fact- sheets/tourette-syndrome-fact-sheet

2. https://tourette.org/about-tourette/overview/what-is-tourette/

3. https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/tourette- syndrome/symptoms-causes/syc-20350465
4. https://www.researchgate.net/topic/Tourette-Syndrome
5. https://youtu.be/23uFSI2NF70

Leave a Comment

Skip to content