Euthanasia (ইউথেনেশিয়া) নামে একটি শব্দ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এই শব্দটির বাংলা অনেকে এভাবে করেন যে আরামের মরন বা স্বেচ্ছামৃত্যু। ইউথেনেশিয়ানিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরকম আইন আছে।
জার্মান ফ্যাসিস্ট হিটলার চেয়েছিলেন জার্মানির মানুষদের একটি “খাঁটি জার্মান” জাতি হিসেবে তৈরি করতে। তাই হিটলার মেডিকেল ক্যাম্প, শুদ্ধি অভিযান এইসব নামে বিভিন্ন সময় তার সাথে শারীরিক গঠন কিংবা রং এ পার্থক্য আছে এরকম মানুষদের হত্যা করেছেন। এমনকি খাঁটি জার্মান জাতি তৈরির লক্ষ্যে অবিবাহিত মেয়েদের জার্মান সৈন্যদের দ্বারা গর্ভবতী করিয়েছেন। ইতিহাসে এটি নাৎসি অথবা নাজি মুভমেন্ট নামে পরিচিত।
ইউথেনেশিয়ার নামে অনেক সময় দূর্বল, প্রতিবন্ধী কিংবা সামাজিক দক্ষতায় একটু পেছানো মানুষদের আরামের মরনদেয়ার নামে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলো হিটলারের আমলে। ঠিক এমন সময়েইঅস্ট্রিয়ায় জন্ম নেয়াশিশুচিকিৎসা-তাত্ত্বিক (pediatric theorists) অধ্যাপক হ্যান্স আ্যাসপার্গার তখন কর্মরত ছিলেন অক্ষশক্তির (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্বাধীন জোট) একটি মেডিকেল ক্যাম্পে। সেখানে তার কাছে এরকম বাচ্চাদের নিয়ে আসা হতো যে তারা স্বাভাবিক কিনা অথবা এরা জাতির জন্য ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে কিনা এসব পরীক্ষা করার জন্য।
এখানে যারা প্রতিবন্ধী কিংবা দূর্বল হিসেবে চিহ্নিত হতো তাদের হত্যা করা হতো ইউথেনেশিয়া আইনে।ক্যাম্পে কর্মরত অবস্থায় আ্যাসপার্গারের কাছে নিয়ে আসা শিশুদের মাঝে কিছু শিশুকে তিনি এমন পেলেন যে তারা হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক আবার কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষ এবং প্রতিভাবান। হয়তো কেউ ভালো গান গাইতে পারে,কেউ গণিতে দক্ষ,কেউঅভিনয়ে অথবা লেখালেখিতে। এরকম কিছু শিশু নিয়ে আ্যাসপার্গার ভাবতে শুরু করলেন এবং এক সময়ে তাদের ব্যবহার চালচলনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পেলেন। হ্যান্স আ্যাসপার্গার লক্ষ্য করলেন তাদের মধ্যে সাধারণত সামাজিক ব্যবহার এবং অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ত্রুটি দেখা যায়। কারো কারো অবশ্য ভাষা ব্যবহার এবং কথা বলার ক্ষেত্রে ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। একই কাজ বারবার করার প্রবণতা এবং বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে আগ্রহী এবং মনোযোগী (Focused) থাকতে দেখা যায়। এরকম চারজন শিশু নিয়েআ্যাসপার্গার গবেষণা করে ১৯৪৪ সালে তার গবেষণা ” অটিস্টিকসাইকোপ্যাথি” নামে প্রকাশ করেন। অস্ট্রিয়ান নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আলফ্রেড জেলিনেক হলেন আ্যাসপার্গার এর গবেষণার স্যাম্পল শিশু চারজনের একজন। আ্যাসপার্গারের গবেষণা প্রকাশিত হবার অনেক বছর পরএটিআন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রচারিত হতে শুরু করে।১৯৮১ সালে ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানীলর্না উইং এই বিশেষ ধরনের বৈকল্যকে “আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোম” নামে নামকরণ করেন।
আ্যাসপার্গারের সনাক্তকৃত এই বিশেষ বৈকল্যকে ১৯৯৪ সালে Diagnostic and statistical manual of mental disorders (DSM) এর চতুর্থ সংস্করণে অটিজম থেকে আলাদা একটি বৈকল্যে হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অবশ্য ২০১৩ সালে প্রকাশিত DSM-5 এ আ্যাসপার্গার সিনড্রোমকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার(ASD) নামে আমব্রেলাটার্ম এর অন্তর্ভুক্ত করে হাই ফাংশনিংঅটিজম নামে পরিচিত করা হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে আ্যাসপার্গার এর জন্মদিন ১৮ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব আ্যাসপার্গার দিবস নামে পালন করা হয়।
আ্যাসপার্গার সিনড্রোমে আক্রান্তদের মধ্যে সাধারণত সামাজিক যোগাযোগের অক্ষমতা, কন্ঠের ওঠানামা বুঝতে না পারা,ব্যাঙ্গ কিংবারসিকতা বুঝতে না পারা,
নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের প্রতি আগ্রহ এবং বিশেষ বিষয়ে পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। কোনো বিষয়ে তীব্র মনোযোগ, কোনো কিছুচিহ্নিতকরণে এদের পারদর্শিতা অতুলনীয়। কিন্তু আ্যাসপার্গারসিন্ড্রোমের রোগীদের কারো আলো, স্পর্শ, তাপ, শব্দ ইত্যাদির প্রতি স্পর্শকাতরতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, অবাচনিক যোগাযোগ বিশেষ করে অক্ষিসংযোগ (Eye contact) ত্রুটি, হুটহাট অদ্ভুত চলাফেরা, বিনা কারনে হাত পা নাড়ানো,হতাশা এবং ভীতি লক্ষ্য করা যায়।
২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা গেছে যে পৃথিবীতে ৩৭.২ মিলিয়ন মানুষ আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। এই সিন্ড্রোমের কারন এখনো অজানা। আগে ধারণা করা হতো মস্তিষ্কের আকৃতি অথবা কোনো অংশের অস্বাভাবিকতা এর কারণ। কিন্তু আধুনিক নিউরোইমেজিং টেকনিক ব্যবহার করে এরকম কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। অনেক গবেষক মনে করেন জিনের অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন হয়তো আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোমের জন্য দায়ী।
কগনিটিভ বিহেভিয়ারথেরাপি,স্পিচথেরাপি,সোশালস্কিল ট্রেনিং হলো আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোমেরচিকিৎসা। এছাড়াফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে এই সিন্ড্রোম অনেকটাই দূর করা সম্ভব।
আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোম এ আক্রান্ত মানুষেরা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো প্রতিবন্ধকতায় ভুগেন না, যেকোনো বিশেষ একটি বিষয়ে ফোকাসড এবং রুটিন ব্যবহারে অভ্যস্ত তাই তারা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, টাইপিং, এরকম সৃজনশীল এবং একঘেয়ে কাজে অনেক দক্ষ হয় বলে দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ কিংবা সামাজিক দক্ষতাই আ্যাসপার্গারসিন্ড্রোম এর মূল চ্যালেঞ্জ। তবুও তাদের অনেকেই এই চ্যালেঞ্জ উৎরে যান। এমনই একজন মানুষ যাঁর নিজেরই এই ব্যাধি আছে৷ তাঁর নাম আলেক্সান্ডার প্লাংক৷ মাত্র নয় বছর বয়সে তাঁর এই ব্যাধি দেখা দেয়৷ ২০০৪ সালে তিনি “রং প্লানেট” নামে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করেন। রং প্লানেটের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এই যোগাযোগ মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত মানুষেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ এবং বিভিন্ন আলোচনা করতে পারে।
২০০৬ সাল থেকে প্লাংকইউটিউবে Autism Speaks TV নামে একটি চ্যানেল খুলে তাতে অটিজম আক্রান্ত মানুষের জীবনধারা, বিভিন্ন কাজে কিভাবে তারা অংশগ্রহণ এবং সাফল্য লাভ করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করে থাকেন।
আ্যাসপার্গার সিন্ড্রোম আক্রান্ত নৃবিজ্ঞান এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর গ্রাজুয়েট ডেবিট জেমস সেবারিসি এবার ২ এপ্রিল ২০১৯ এ অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘে আয়োজিত সেমিনারে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন । সেবারিসি Deej নামে দর্শক নন্দিত একটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং প্রযোজক।
এভাবেই সঠিক শিক্ষা এবং চিকিৎসার মধ্য দিয়েআ্যাসপার্গারসিন্ড্রোম অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। আ্যাসপার্গারসিন্ড্রোম এ আক্রান্ত মানুষেরাও অবদান রাখতে পারেন নতুন পৃথিবী গড়ার আন্দোলনে। তারা অভিশাপ নয় বরং হয়ে উঠতে পারেন সম্পদ।
আচ্ছা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম Wrong Planet কেন? এই পৃথিবীতে তাদের জন্মগ্রহণ করা wrong নাকি আমরা স্বাভাবিক মানুষেরা তাদের কাছে পৃথিবীকে Wrong হিসেবে উপস্থাপন করছি?
তথ্যসূত্র:
1.https://www.ninds.nih.gov/disorders/all-disorders/asperger-syndrome-information-page.
2.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hans_Asperger.
3.http://www.djsavarese.com
4.https://wrongplanet.net
5.https://m.dw.com
6.https://Youtube.com/autismspeakstv
7.https://www.asha.org
8.https://www.autismspeaks.org
9.https://www.autism.org.uk/about/what-is/asperger.aspx
10.http://www.autism-society.org/what-is/aspergers-syndrome/
11.http://www.aspennj.org/
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য (Communication Disorders) বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে পাঠগ্রহন চলছে। প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছি। উদ্ভাবনী গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে চিন্তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত।