তোতলামি একটি বাচন বৈকল্য

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সাল। তখন তত্ত্ববধায়ক সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন। রিংকুর গতরাতে ঘুম হয়নি, কারণ আজ সকালে সে পিংকিকে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে হাফপ্যান্ট পরা যুগ থেকে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে দিতে চায়। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, রিংকু কথা বলতে গেলে প্রায়ই কথা আটকে যায়। ভালোবাসার জন্য “সাত সমুদ্র তের নদী দিব পার” এই মোটিভেশন নিয়ে রিংকু পিংকির সামনে গিয়ে সৈনিকের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর চারগুণ বেশি দামে কেনা আধেক-ফুটিত গোলাপ সামনে বাড়িয়ে বলতে শুরু করে-

আ আ আ আ মি……………….

এই ঘটনার বাকি অংশ লেখক শতচেষ্টা করেও জানতে পারেননি। রিংকুর কি পিংকির সাথে প্রেম হয়েছিলো? ‘দৈনিক যায় যায় প্রেম’ পত্রিকায় কি তাদের ছবি ছাপা হয়েছিল?

প্রিয় পাঠক! এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরের অংশটুকু আপনাদের জানা থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করছি।

শুধু রিংকু কিংবা মন্টু অথবা হৈমন্তী নয়। আমাদের সমাজে কথা বলার সময় তোতলামি(Stuttering) করে এমন অনেক মানুষ আমাদের আশেপাশে রয়েছেন। এই লেখাটিতে তোতলামি, তোতলামির প্রকারভেদ, কারণ, প্রতিকার ইত্যাদি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করা হবে।

তোতলামি(Stuttering) হচ্ছে একটি উচ্চারন বা বাচনিক ত্রুটি যেখানে কথাবার্তার দ্রুততা, অস্পস্টতা, কথা আটকে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। তোতলামির সাথে সাথে বার বার চোখের পলক ফেলা, অযাচিতভাবে ঠোঁট নাড়ানো লক্ষ করা যায়। এটি একজন মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রাকে কঠিন করে দিতে পারে। তোতলামি বৈকল্যটি মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশেরই হয়ে থাকে যেটি সাধারনত একটি মাত্রা পর্যন্ত অনেকেই খেয়াল করেননা বা এটাকে একটি রোগ বা বৈকল্যের দৃষ্টিতে দেখেন না। কারো সামনে প্রথমবার মত কথা বলতে গেলে, পাবলিক স্পিকিংয়ে, ফোনে কথা বলতে গেলে, ভয় পেলে এরকম পরিস্থিতিতে তোতলামি বেশি হয়ে থাকে। আবার গান গাওয়ার সময়, কবিতা আবৃত্তি, গল্প বলা এরকম সময়ে কম হয়ে থাকে। Stuttering কে অনেক সময় Stammering বলে। এছাড়াও অনেকে এটিকে Disfluent Speech ও বলে থাকেন।

কারা এই বৈকল্যতে ভুগেন?

তোতলামি এটি প্রায় সকল বয়সের মানুষদের সাথেই হতে পারে। বাচ্চাদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ একটা সময় পর্যন্ত তোতলামিতে ভুগে। ছেলেরা মেয়েদের চাইতে বেশি এই বৈকল্যতে ভোগে বলে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে।

কেন এই বৈকল্য হয়?

তোতলামির কারণ খুঁজতে গেলে মোটাদাগে তিনটি বিষয়কে বর্ণনা করা যায়।

  1. Developmental Stuttering : যখন বাচ্চারা কথা বলতে শিখে তখন তাদের ভাষাগত বিকাশ ঠিকমত না ঘটলে তোতলামি হতে পারে। বাচ্চারা প্রথমে কথা বলার সময় প্রায়ই আটকিয়ে কথা বলে তাই তখন Stuttering কি না তা চিহ্নিত করতে পারা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।
  2. Neurogenic Stuttering : আমাদের Brain আর Speech nerve ঠিকমত কাজ না করলেও Stuttering হতে পারে। এটি বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়দেরও হতে পারে। অনেক সময় বয়স্ক কেউ স্ট্রোকস করলে Stuttering লক্ষ করা যায়। নিচের কিছু কারনে Neurogenic Stuttering হয়:- Stroke, Head Trauma, Ischemic Attacks, Tumors, Degenerative Diseases, Meningitis।
  3. Psychological Factors: অনেকে মানসিকভাবে দুর্বল থাকলে অথবা ভয় পেয়েও Stuttering করে। Stress, ভয়, বিব্রতকর পরিস্থিতি, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কারনেও Stuttering অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে।

Stuttering এর লক্ষণমূহ কি কি?

  • কথা বলার সময় ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করে। কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে কস্ট হয়।
  • কথা বলার সময় শারীরিক পরিবর্তন যেমন – দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়া, বারবার চোখ বন্ধ হওয়া, চিন্তিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
  • কথা বলার সময় বারবার থেমে যাওয়া বা কথা বলতে না চাওয়া।
  • কথার সাথে স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি কথা সহযোগী বিষয়(Paravocal speech) ব্যবহার বলা যেমন – উম, আহ ইত্যাদি।
  • একই বাক্যে ব্যবহৃত শব্দগুলার মধ্যে পরিবর্তন এনে ফেলা।
  • একটি শব্দকে টেনে লম্বা করে ফেলা।
  • একটি শব্দ বারবার বলতে থাকা।
  • কোনো শব্দ বা ধ্বনিতে আটকে থাকা‌।

তোতলামির প্রকারভেদ:-

তোতলামির ধরন বর্ণনা করলে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

  • Blocks: এটি হয় কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করার পরেও কথা বলতে না পারলে। দেখা যায় অনেক সময় ধরে চুপ আছে তারপরেও কথা বলতে পারছেন না। যেমন – আমাকে একটি কলম ……
  • Prolongations: কথা টেনে টেনে বড় করা
    যেমন – চিইইইইইইইকেন।
  • Repetations: বার বার একটি শব্দাংশ বলা । যেমন – আ আ আম্মু ।

Stuttering এর কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর: –

পারিবারিক ইতিহাস: অনেক সময় পরিবারের কারও Stuttering থাকলে পরিবারের নতুন সদস্যেরও Stuttering হতে পারে।

বয়স: একটি বাচ্চা ৩.৫ বছরের আগে Stuttering করলে পরবর্তীতে Stuttering করে না। যত আগে Stuttering হবে বাচ্চার তাদের ক্ষেত্রে সাধারনত দেখা যায় যে পরবর্তীতে তাদের মধ্যে Stuttering থাকে না। বাচ্চারা যারা Stuttering করে তারা ১-২ বছরের মধ্যে Stuttering বন্ধ করে দেয় স্পিচ থেরাপি ছাড়াই। যত বেশি সময় Stuttering করবে তত ঝুকি বেশি পরবর্তী সময়েও Stuttering করার।

কখন Stuttering নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত :-

  • যখন বাচ্চাটি ৬ মাস এর অধিক সময় ধরে Stuttering করছে।
  • Stuttering যখন প্রায়ই হচ্ছে।
  • Stuttering এর সাথে সাথে Facial Nerve গুলিরও পরিবর্তন লক্ষ করা যায় সাথে পেশি নড়াচড়ায় সমস্যা হলে।
  • যখন কান্না বা ভয় পেলে অনেক Stuttering করে।
  • যখন বাচ্চার বয়স ৫ এর অধিক পার হয়ে যায় কিন্তু Stuttering থামে না।

তোতলামির চিকিৎসা :

তাৎক্ষনিক ভাবে Stuttering বন্ধ করার জন্য –

  • Focus on Breathing: কথা বলার সময় নিঃশ্বাস এর দিকে খেয়াল করে কথা বলা। বেশি দ্রুত কথা না বলা। ধীরেসুস্থে কথা বললে রক্ত সঞ্চালন ভাল হয় ফলে তোতলামিও কম হয়।
  • Avoid Certain Words: কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলা উচ্চারণ করতে একজন Stuttering আক্রান্ত মানুষের খুব কষ্ট হয়। সেসব শব্দ ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে একজন স্পিচ থেরাপিস্ট ভাল পরামর্শ দিতে পারবেন।
  • Speak with a Rhythm: অনেকেই নরমালি কথা বলতে গেলে আটকিয়ে যান কিন্ত গান গাওয়ার সময় সাধারণ ভাবেই গান গাইতে পারেন। তাই কথা বলার সময় গানের ছন্দে কথা বলছে এটা ভেবে কথাবার্তা চালাতে পারে বা ছন্দে ছন্দে কথা বলতে পারেন।
  • Visualize Interactions: অনেকে কথা বলার সময় যা বলতে চান সেটি মনে মনে কল্পনা করে নেন। এটি করলেও তোতলামি কমে আসে।

তোতলামি থেকে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পেতে চাইলে-

Speech Therapy: এই থেরাপি দিয়ে বার বার কথার মধ্যে বাধা দেয়া কমানো যেতে পারে, থেরাপির সময় বাচ্চার কথা বলার দ্রুততা, শ্বাস নেয়ার মাত্রার দিকে খেয়াল করা হয়। একজন মানুষের ঠিক তখন স্পিচ থেরাপি নিতে হবে যখন দেখা যাবে যে,

  • ৩-৬ মাস যাবত Stuttering আছে। 
  • Stuttering নিয়ে অনেকদিন যাবত সমস্যায় রয়েছে।
  • যাদের পরিবারের মধ্যেও Stuttering আছে।

Controlling Monitoring Speech Rate: এই পদ্ধতিতে বাচ্চার কথা বলার দ্রুততা, অস্পস্টতা, বাক্য গঠনের নিয়ম ইত্যাদি খেয়াল করা হয়। রোগীকে বলা হয় স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ যাতে ধীরে একটু টেনে টেনে উচ্চারণ করতে পারে। অনুশীলন করলে ধীরে ধীরে রোগীর মধ্যে একটি লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আসে। কথা টেনে টেনে বলার সাথে সাথে শ্বাস আটকে রাখার অভ্যাস ও হয়ে যায়।

Electronic Fluency Devices: একটি হেডফোন দিয়ে রোগীকে কথা শুনানো হয় যাতে রোগী মনে করে কারও সাথে সে কথা বলছে। এভাবে অনেকেরই Stuttering ভাল হয় আবার অনেকের ক্ষেত্রে এটি কোন কাজে আসে না।

অনেক সময় মানুষ নিজের Stuttering লুকাতে গিয়ে নিজেকে আরও বিপদে ফেলে দেয়। অনেক সময় শ্রোতারা বিরক্ত হয় Stuttering দেখলে এতে করে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের এটা খেয়াল রাখতে হবে যে ব্যাক্তি Stuttering এ আক্রান্ত তিনিও আমাদের মত সাধারণভাবে কথা বলতে চান। কিভাবে বলছেন একজন মানুষ তারচেয়ে আমাদের কে উনি কি বলতে চান আমাদের সেটাতে খেয়াল করা উচিত। যিনি Stuttering এ আক্রান্ত আমাদের উচিত তাকে বলা যাতে তিনি শান্ত হয়ে কথা বলেন। এতে করে লোকটিও কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। কথার পৃথিবীতে সবাই লাভ করবে কথা বলার জন্মাধিকার।

Reference :
1.Speech Correction By Charles Van Riper

2.https://www.healthline.com/health/stuttering#symptoms

3.https://www.medicalnewstoday.com/articles/10608.php

4.https://www.medicinenet.com/stuttering/article.htm

5.https://journals.plos.org/plosbiology/article…

6.https://www.medicalnewstoday.com/articles/321995.php

 

লেখক
শোয়েব আদনান
শিক্ষার্থী, PISER, BUP

Leave a Comment

Skip to content