ল্যারিংজেকটমি(Laryngectomy) হলো একটি অপারেশন যেটির মাধ্যমে স্বরযন্ত্র (Larynx/voice box), যেই অঙ্গের সাহায্যে আমরা কথা বলার জন্য কম্পন (Vibration) এবং ধ্বনিতকরণ (Voicing) করি সেটিকে সার্জারি করে সরিয়ে ফেলা হয়। এই অপারেশন সাধারনত ঠিক তখনি করা হয় যখন স্বরযন্ত্রের ক্যান্সারের এমন পরিস্থিতি হয় যে কেমোথেরাপিতেও কাজ হয় না। এছাড়া গুলি লাগলে বা গলার হাড় ভেঙে গেলে অথবা স্বরযন্ত্রে অন্য কোনভাবে আঘাত পেলে, তখন এই অপারেশনটি করতে হয়। এই অপারেশনের পর সাধারণভাবে রোগী আর কথা বলতে পারে না।
Laryngectomy অপারেশনের পর রোগীর উপর কিছু প্রভাব পড়ে। এগুলো হলোঃ
- গলার মাঝখান দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হয় ফলে আগের মত নাক দিয়ে বাতাস গরম হয়ে বের হয় না।
- হাঁচি বা নাক ঝাড়তে পারে না।
- অনেকদিন পর্যন্ত খাবার এর স্বাদ পাবে না। কোন কিছুর ঘ্রান/গন্ধ পাবে না।
- খাবার খেতে সমস্যা হয়, গিলতে সমস্যা হয়।
- কোনকিছু ধাক্কা দিয়ে বা গায়ের জোরে সরাতে পারবে না তাহলে Laryngeal valve নড়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
- গোসল করার সময় খুবই সতর্ক থাকতে হয় যাতে STOMA ঢেকে না যায় কারণ ঢেকে গেলে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। সাঁতার কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ।
- শরীরের শারীরিক গঠন হঠাৎ পরিবর্তনের কারণে আশেপাশের পরিবেশে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল হঠাৎ করে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার কষ্ট। যার এই Laryngectomy অপারেশন হয় তাকে Laryngectomee বলে।
গলার বাচন যন্ত্র চলে যাওয়ার ফলে রোগী আর আগের মত কথা বলতে পারে না। কিন্তু এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগী কথা বলতে সক্ষম হতে পারে এবং তা আগের চেয়েও স্পষ্ট ও পরিস্কার ভাবে।
সার্জারির পরে প্রথম কয়েকদিন মুখ ব্যবহার না করেই আকার ইংগিত দিয়ে বেশীরভাগ কাজ চালাতে হয়। বেশীরভাগ জিনিসই হ্যা/না দিয়ে করতে হয়। যেমনঃ কিছু জিজ্ঞেস করলে একবার Blink (চোখ বন্ধ করে খুললে) করলে হ্যা আর ২বার ব্লিংক করলে না। অনেক কাজের ছবি দেখিয়েও রোগীর সাথে যোগাযোগ করা যায়। আস্তে আস্তে রোগী নিজেই বুঝে লিখে দেখানোর চেয়ে কথা বলে ভালভাবে বুঝানো যায়। তখন রোগী ARTIFICIAL LARYNX এর প্রতি ঝুঁকে যায়।
Laryngectomy অপারেশনের কারনে হারিয়ে যাওয়া বাচন বা কথা বলার ক্ষমতা আবার তিনটি পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব:
- .Electrolarynx
- Esophageal Speech
- Tracheo-Esophageal Puncture(TEP)
Electrolarynx
Electrolarynx হলো এমন একটি ডিভাইস যেটি আপনার স্বর এর জায়গায় অন্য একটি বৈদ্যুতিক স্বর/আওয়াজ প্রদান করে। এটি অপারেশন এর পরপরেই ব্যবহার করা সম্ভব। কিন্তু এটির জন্য বাচন-চিকিৎসক (Speech Language Pathologist) এর পরামর্শ প্রয়োজন। তার সাহায্য ছাড়া এটি ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এটি Straw Adapter এর মতো, প্রথমে একটি Straw মুখের ভেতর দিয়ে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে ক্ষত শুকিয়ে গেলে ডিভাইসটি গলায় লাগিয়ে দেয়া হয়। এটি গলায় পরানো হয় যেখানে Larynx থাকে সেখানে। কয়েকদিন প্র্যাক্টিস করলে সহজেই বুঝা যায়। একজন Laryngectomee সাধারনত প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে থাকে। এটা ব্যাটারি দ্বারা চালিত হাত দিয়ে ধরতে হয় অনেকটা Electronic Buzzer এর মত। সার্জারির কয়েক সপ্তাহের পরেই ব্যবহার করা যায়। স্পিকারফোন ব্যবহার করার সময় ব্যবহার করা যায়। আস্তে আস্তে ধীরগতিতে কথা বলতে হয়। এটি আশেপাশের বাইরের আওয়াজও ধরতে সক্ষম হয়, যেটির ফলে কথাবার্তা বুঝা আরও সহজ হয়।
সুবিধা: প্র্যাকটিস এর সাহায্যে আস্তে আস্তে কথা বলতে সক্ষম হয় এবং তা বেশ পরিস্কারভাবেই।
অসুবিধা: একটি ইলেক্ট্রিক আওয়াজ আসে যন্ত্র থেকে যেটি অনেকের জন্য অসুবিধার কারন হতে পারে।
Esophageal Speech:
এই পদ্ধতিকে অনেকে ঢেঁকুর তোলা (Burp-Talking) পদ্ধতিও বলে থাকেন। এটি একটি বিকল্প vibrator। যেটি Esophagus এর সাথে মিলিত হয় এবং টিউবটি পাকস্থলীতে গিয়ে বাতাস এর কারনে খাদ্যনালীতে কম্পন সৃষ্টি করে। একজন SLP (speech language pathologist) এর কাজ হল Laryngectomee কে নতুন নতুন ALryngeal voice ব্যবহার এর পদ্ধতি শিখানো। অনেক বাচ্চারা Burp করে তার সাথে এই burp এর পার্থক্য হল যে একজন SLP এটা শিখায় যে পাকস্থলী থেকে বাতাস সরাসরি উপরে আসে না, এটি Esophagus এ আটকিয়ে থাকে বের হওয়ার আগে। এই পদ্ধতির জন্য রোগী তার নিঃশ্বাস নেয়ার পদ্ধতি ভালভাবে বুঝতে হবে।এই পদ্ধতিতে Esophagus এর উপরের পেশী শব্দের কম্পন উৎস (vibrating source) হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিচু স্বর এর আওয়াজ এবং কর্কশ আওয়াজ হয়। একি নিঃশ্বাস এ ২-৬টি শব্দ ব্যবহার করতে পারে। এটি ব্যবহার করতে Electrolarynx থেকে বেশি প্র্যাকটিস এর প্রয়োজন।
সুবিধাঃ ব্যাটারি বা কোন ইমপ্ল্যান্ট এর প্রয়োজন নেই।
অসুবিধাঃ বারবার থামার প্রয়োজন হয় কথা বলার সময়ে যা করার স্রোতে(continuous flow) বাধার সৃষ্টি করে।
Tracheo-Esophageal Puncture (TEP):
কথা বলার জন্য একজন Laryngectomee এর সবচেয়ে জরুরী ২টি জিনিস প্রয়োজন। তা হলো একটি Vibration Sourceএবং একটি Power Supply।
আমরা দেখেছি Electrolarynx এ Vibration আর Power supply দুটিই পাওয়া যায় কিন্তু এটি শরীরের বাইরে থাকে তাই বাইরে থেকে দেখা যায়।অন্যদিকে Esophageal Speech জিনিসটা Larynx এর বিকল্প হিসবে Pseudoglottis এর ব্যবহার এবং Power এর জন্য বাতাস আনা নেয়ার মাধ্যম। বাতাস আনা নেয়া এবং দ্রুত ধরে রাখা বা ছেড়ে দেয়াই হচ্ছে Esophageal Speech এর সবচেয়ে জটিল দিক। Tracheo Esophageal Puncture হচ্ছে কথা ফিরিয়ে আনার একটি পদ্ধতি, যেখানে এমন এক দেয়ালে গর্ত করা হয় যেটি ট্রাকিয়া(Windpipe) এবং Esophagus এর মাঝামাঝি। এটি Laryngectomy অপারেশন এর সময়েই করা হয়। পরেও করা যায় চাইলে। শরীর সুস্থ হলে গলায় voice prosthesis পরিয়ে দেয়া হয়। এই ডিভাইসকেই Tracheoesophageal voice Prosthesis বা TEP বলে। এই ডিভাইসটি ভাল্ভ এর মত কাজ করে যেটি Esophagus এর মধ্যে বাতাস যেতে সাহায্য করে এবং মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতেও সাহায্য করে। এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উপকারি এবং ভাল পদ্ধতি কথা,বাচন ফিরিয়ে আনার।ভাল্ব টা সবসময় একি জায়গায় থাকে।
Power এর জন্য রয়েছে ফুসফুস। তবে নিয়মিত চেক করা লাগে।Esophageal Speech এর চেয়ে অনেক বড় বাক্য বলা যাবে।SLP এর সাহায্যে প্র্যাকটিস করলে অনেক উন্নতি হয়।
সুবিধা: কথা বা বাচন নিঃশ্বাস এর বাতাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, বারবার বাতাস আনা নেয়ার মাধ্যমে নয়।
অসুবিধা:অনেক সময় অপারেশন এর সময়ে ঝামেলা হয়। এছাড়া নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। ৩ মাস পরপর পাল্টাতে হয়।
অনেক সময় উপরের তিনটি পদ্ধতির একটিও কাজ নাও করতে পারে আপনার জন্য। তখন একজন Speech language Pathologist আপনাকে Electronic Speech Generating Device ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারে।
Electronic Speech Generating Device এমন এক ডিভাইস যেটি আধুনিকভাবে মানুষের আওয়াজ প্রদান করতে পারে। Electronic Speech Generating যেমন হতে পারে –
- keyboards: বাক্য লেখলে Electronically উচ্চারণ করতে পারে।
- Pictures : ছবিতে চাপ দিলে আওয়াজ করবে।
- Tablet-Computers – সফটওয়ার যেগুলো দিয়ে স্পিচ উৎপন্ন করা যায়।
- Augmentative Alternative Communication (AAC) – সাধারণভাবে কথা না বলতে পারলে অন্য পদ্ধতি যেমন Gesture – ইশারা ইংগিত, হ্যা/না দিয়ে বুঝানো, কথা দিয়ে, ইমোশন দিয়ে বুঝানো ইত্যাদি।
সর্বোপরি এটা বলতে পারি যে পরিপূর্ণ সুযোগ সুবিধা পেলে একজন Laryngectomee এর পক্ষে আবার নিরাপদ সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব।
তথ্যসূত্র:
1.https://www.practicalslpinfo.com/functional-changes-after-l…
2.http://www.sw.org/…/head-…/voice/head-neck-voice-restoration
3.Speech Correction by Charles Van Riper
4.A Pocketguide to assessment in SLP
লেখক
শোয়েব আদনান
শিক্ষার্থী, PISER, BUP
বাংলা ভাষায় এই সর্বপ্রথম যোগাযোগ বৈকল্য আছে এমন মানুষদের সমস্যা, সমাধান, সম্ভাবনা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ের একমাত্র ব্লগসাইট। আপনিও প্রতিবন্ধকতা কিংবা যোগাযোগ বৈকল্য সম্পর্কিত লেখা পাঠাতে পারেন blog@connectingdisorders.org এই ঠিকানায়। আমাদের অভিজ্ঞ রিভিউ প্যানেলের সম্পাদনা শেষে আপনার লেখা প্রকাশ করা হবে এই ব্লগে।