নিখুঁতের খুঁত

নিখুঁত খুঁতের কলঙ্কমুক্ত নয়।
                                        প্রাচীন গ্রীক প্রবাদ

নিখুঁত বলতে আমরা এমন একটা অবস্থা বুঝি যা সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত এবং অপূর্ণতাবিহীন। কিন্তু এমন কিছুর কি বাস্তবতা আছে। সত্যিই কি নিখুঁতের অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে?

আপনি কি কখনো নিখুঁত আকাশ দেখেছেন অথবা নিখুঁত কোন গাছ? আকাশের দিকে তাকালে ছিটেফোঁটা মেঘ কি খুঁতের অথবা ত্রুটির অস্তিত্ব জানান দেয় না? সাদা বায়ুমণ্ডলের আকাশ আলোর বিক্ষেপণের কারণে দৃষ্টিগোচর হয় নীল হিসেবে, তাও আবার প্রকৃত নীল নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, একটি গাছে হয়তোবা বাকল অথবা পাতা, ডাল না হয় জীবনীশক্তির কিছু খুঁত বিদ্যমান।

স্বয়ং নিখুঁত শব্দটি কি খুঁতমুক্ত মৌলিক শব্দ? না! এটি ‘নি’ উপসর্গ যোগে গঠিত সাধিত শব্দ।

পৃথিবীতে সাতশ কোটির অধিক মানুষের বসবাস। কোন একজন মানুষ কি বুকে হাত দিয়ে এটা প্রমাণ করতে পারবেন, যে তিনি একজন সম্পূর্ণ মানুষ। আমাদের যার ওপরে অগাধ বিশ্বাস, সেই বিজ্ঞান কি ঘোষণা করতে পেরেছে মানুষকে নিখুঁত মানুষ হিসেবে?

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির মানবেরও আছে দ্রুততার সীমা। সে ত্রুটিমুক্ত দ্রুততার অধিকারী নয়। সবচেয়ে বেশি স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন মানুষটিও স্মৃতির সীমারেখা উৎরে যেতে পারেননি।

আপনি স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেননি জীবনের শুরু থেকে যা শিখেছিলেন। নিজেকে কোনো না কোনো মাত্রার স্মৃতি বৈকল্যের বৈশিষ্ট্যধারী বলে মেনে নিতে দ্বিধা করা কি উচিত নয়? আপনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় (Social Interaction) একজন সক্ষম ব্যক্তি। তবে এটা সত্যি না যে, আপনার থেকে এই যোগ্যতায় কেউ বেশি সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। তবে আপনি দ্বিতীয় ব্যক্তির তুলনায় কম সক্ষম মেনে নিতে আপত্তি আছে?

আপনি কথা বলতে পারেন। অন্য একজন মানুষ কথা বলতে পারেনা। মাধ্যমবিহীন (কোনো মাধ্যম ছাড়া শব্দ সঞ্চালিত হতে পারে না, আমরা সাধারণত বায়ুকে কথা বলার সময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি) কোনো স্থানে গিয়ে কি আপনি শ্রুতিসম্পন্ন (Audible) কথা বলতে পারবেন? তবে তো আপনিও কথা বলার ক্ষেত্রে অক্ষমতার উর্দ্ধে নয়। হয়তো আপনার সক্ষমতার বিচরণসীমা একটু বেশি কিন্তু তা নিঁখুত বা পরম নয়।

আপনি হয়তো কানে শুনতে পারেন। এর মানে এমন নয় যে, আপনি সব মাত্রার শব্দ শুনতে পারেন। বিশ হার্জের (হার্জ শব্দ পরিমাপের একক) নিচের মাত্রার শব্দ আপনি শুনতে পান না। যা শুনতে পায় পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র জীব। আবার বিশ হাজার হার্জের উপরের শব্দ আপনি শুনতে সক্ষম নন। যা শ্রবনের সক্ষমতা আছে বাঁদুড় এবং কুকুরের মতো প্রানীর। সুতরাং আপনার চেয়ে যিনি কম শুনতে পান তাকে উপহাস করার অধিকারকে অমূলক বললে কি ভুল হবে?

নিজে একজন নিখুঁত মানুষ না হয়ে, অন্য একজন মানুষকে উপহাস করা, সত্যিকার অর্থে একজন উলঙ্গ মানুষের পক্ষে অন্য আরেকজন উলঙ্গ মানুষকে নেংটা বলার মতোই হাস্যকর।

জেনে রাখুন, নিখুঁত একটি পরম আদর্শ মান অথবা একটি ধারনা মাত্র। আপনি কখনো তা স্পর্শ করতে পারবেন না, কখনোই নিখুঁত মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বাস্তবতাকে মেনে নিন। অন্যকে একটি অসম্পূর্ণতার জন্য উপহাস বা সুবিধাবঞ্চিত করার আগে ভেবে নিন, আপনি কি অসম্পূর্ণতার সীমা অতিক্রম করতে পেরেছেন?

এতো খুঁত ধরার মূল উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন এটুকু মেনে নিতে পারি যে, আমরা কেউ নিখুঁত (perfect) মানুষ নই। সুতরাং আমাদের উচিত হবেনা, আমাদের থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু কম সক্ষম যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত মানুষদের উপহাস কিংবা কোনো নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।

Leave a Comment

Skip to content