আমার হাতেখড়ির গল্প

শিশুকাল হোক বা কৈশোরকাল, চড়াই আর উৎরাই করে যেন সময় হারিয়ে যায়। কিছু সুখ, কিছু দুঃখ, কিছু হাসি, কিছু কান্না, কিছু ভালোবাসার মুহূর্ত যেন সবসময়ই স্মৃতির পাতা আঁকড়ে ধরে রাখে। সত্যিকার অর্থেই সময় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। বয়স তরতর করে বেড়ে চলছে। তবুও যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। মনে হয় যদি ফিরে যেতাম সেই ছোট্টবেলায়! তখন কি মজাটাই না করতাম! আবারো খেলনা নিয়ে খেলা, লুকোচুরি, কানামাছি ও দুরন্তপনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম।
 
তবে জীবনের কতগুলো বিশেষ মুহূর্ত থাকে যা আজীবন মনে থাকে। আমার কাছে ছোট্টবেলার সেই শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হলো হাতেখড়ি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মজার গল্প রয়েছে এর পেছনে। যদিও ডিসলেক্সিয়া বললে আমার কাছে একটি অনুপ্রেরণা গল্প ফুটে ওঠে। ডিসলেক্সিয়া শব্দটি আমাকে অন্যরকম শক্তি যোগায়। ‘তারে জমিন পার’ চলচ্চিত্রে ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষক আমির খানের এবং তাঁর ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ছাত্রের কথা। ডিসলেক্সিয়া থাকলে যে জীবনে বড় কিছু হওয়া যাবে না তা ঠিক নয়। শেষ পর্যন্ত তো ওই ছাত্রটি তার নিজের শিক্ষককেই আর্ট প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়ে ১ম হয়েছে। আমার সাথে অবশ্য অন্যরকম মজার ঘটনা ঘটেছে। ছোটবেলায় যখন আমাকে মা ‘অ-আ-ক-খ’ পড়াতো, তখন আমি বলতাম ‘ও-অ-আ-কো-খো’ বা এরকম অদ্ভুত কিছু ধ্বনির বিন্যাস। ‘এ-বি-সি-ডি’র জায়গায় বলে ফেলতাম ‘অ্যা-বি-শি-দি’! বারবার একইরকম ভুল করে ফেলতাম। লিখতে গিয়ে তো এক্কেবারে জগাখিচুড়ী তাকে বলে! খুব খুব বকুনি খেতে হতো তখন! 
 
বাক্য লেখার সময়টাতেও হয়নি কম ভুলচুক। খুবই মনে পড়ে হাতেখড়ি আর বুলি শেখার দিনগুলোর কথা। যেদিন আমি শিখেছিলাম, সেদিন অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে শুনে যেন আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে বলতে শুরু করলাম “অজগোলটি আসচে তেরে- ওলে বাব্বা”! আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে বলার সময় একটু যেন আনন্দ আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি বললাম “আ-আ-আমটি আমি কাবো পেলে”! তারপর ছুটে যেতাম বাড়ির ঐ আমগাছটার নিচে। তারপর রসালো আম খেতাম পেটপুরে। আমার হাতেখড়ি যেন আনন্দ, মজা, কান্না, দুরন্তপনায় ভরপুর ছিলো। আসলেই দিনগুলো আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
 
বাংলা বাক্যের পাশাপাশি ইংরেজি বাক্যেও খেতে হয়েছে হিমশিম। ইংরেজিতে ”এ ফর অ্যাপল”, “বি ফর বল” বলার সময় মজা করে বলতাম “অ্যা পর আপেল, বি পর বোল”! তখন এরকম দুষ্টু আর মিষ্টি ভুলের জন্য বকুনি খেতে হতো। আমার তখন খুবই খারাপ লাগতো। মনে করতাম হাতেখড়ি দিয়ে আমি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাবো! কিন্তু এখন যখন ঐসব দিনের কথাকে চিন্তাজগতে স্থান দিই, তখন বুঝতে পারি আমার দুরন্তপনা, দুষ্টুমি আর মজার ঘটনাগুলো। এবার আসি প্রিয় বিষয় গণিতের কথায়। সে সময়কার ‘গাণিতিক ধারাপাত’ বইটার ছবি আর প্রচ্ছদ এখনো আমার চোখে জ্বলজ্বল করছে। 
 
এক,দুই,তিন বলার সময় বলে ফেলতাম “ইক, ডুই, টিন”- এসব অদ্ভুত আর আজব বুলি। নামতা বা ধারাপাত শেখার সময় আরো বেশি মজা হতো‌। মায়ের কাছে নামতা শেখাটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি। যেমন: দুইয়ের নামতা বলার সময় আওড়াতাম- 
 
“ডুই ইকে ডুই,
ডুই ডো গোনা চাল।” 
 
ফলে গণিতের খেলাতেও পেয়েছি বেশ মজা আর সুখ। তবে হাতেখড়ির সময় সবচেয়ে সাধারণ ঘটনা যাকে কেন্দ্র করে ঘটতো সেটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ‘স্লেটবাবু’! না বুঝেই অনেক সময় দাগ টানা আরম্ভ করে দিতাম। কখনো রাক্ষস বা খোক্ষসের ছবি, কখনো কার্টুন, কখনো ব্যাট আর বল, কখনো আমগাছ, কখনো বা মায়ের ছবিটা আঁকিবুঁকি করার প্রাণবন্ত চেষ্টা করতাম। ভাবতাম আমার মা যদি দেখে আমি মায়েরই ছবি আঁকার চেষ্টা করছি, তখন নিশ্চয়ই পড়াশোনার সময়টা কমিয়ে দিয়ে সৃষ্টি দিদি, রীতি দিদি, লাজ দিদি, সাঁঝ, অপ্সরা, পুঁথি আর সুদেবের সাথে খেলতে দিবে। যাহোক, আমার হাতেখড়ি ছিলো সবার থেকে আলাদা। হাতেখড়ির বদলে হয়তো বা ‘খেলাখড়ি’ বেশি পছন্দের ছিলো।
 
মা বলতো তুই যে বড় হলে কিভাবে পড়বি, উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করবি- তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন। আমার খুবই অভিমান হতো। তবুও মা তো মা-ই। খুবই আদর এবং ধৈর্য সহকারে আমাকে পড়াতে লাগলো। আমাকে বর্ণশিক্ষা দিতে লাগলো। আমি হয়তো বা তখন একটু ভুল করে ফেলতাম, কিন্তু মায়ের ধৈর্য আমাকে বাল্যশিক্ষা নিপুণভাবে দিয়েছে যা ভোলা যায় না। আমার হাতেখড়ি সেজন্য এক বিশেষ কিছু। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-  
          
“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা-    
বিন্দু বিন্দু জল;
গড়ে তোলে মহাদেশ
সাগর অতল”। 
 
আজ আমার সাথেও তেমনটাই ঘটেছে। যদি হাতেখড়ি বলতে কিছু না থাকতো, তাহলে আমি কখনোই এই পর্যায়ে পৌঁছতাম না। আসলে সেই সময়ে পড়া উচ্চারণ করতে বা লিখতে হয়তো বা কিছু সমস্যা হতো। সেটা সবার জন্য সত্য। কিন্তু তবুও যেন এই স্মৃতির পাতা অত্যন্ত জ্বলজ্বলে। তাই আমার আবারো বলতে ইচ্ছে করছে-
 
“ইশ্ এমন যদি হতো, 
হাতেখড়ি শুরু করি- 
ছোট্টবেলার মতো!”
নীলেশ সাহা, ৯ম শ্রেণি, নোয়াখালী জিলা স্কুল।

Leave a Comment

Skip to content