ভাঙা শৈশবে হাতেখড়ি

লাল নীল হলুদ সবুজের মতাে শৈশবেরও একরকম রঙ থাকে। যে রঙে আঁকা হয় সদ্য পৃথিবীর আলাের মুখ দেখা একটি শিশুর তার নিজেরকার শৈশব। মেঘনা নদীর কোলঘেঁষে শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ছবির মতাে এক গায়ে জন্ম নেয়ার পর বােধ করি তেমন কোন রঙেরই অভাব ছিল না। দাদীর কাছে শােনা কথা, আমার জন্মের পর সবাই বলাবলি করছিলাে, মাশা-ল্লাহ হাওয়া বিবির ঘরে চান্দের লাহান একখান পােলা অইছে। কিন্তু মানুষের এ ঘাের ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। আমাকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস আকাশে শঙ্খচিলের মতাে ডানা মেলার আগেই ফুটো বেলুনের মতাে চুপসে যায় একসময়। এমন হবেই না বা কেন! সােনা বাঁকা হলেও তা সােনাই থাকে। কিন্তু খুঁতওয়ালা মানুষ যত সুন্দরই হােক না কেন, তা খুঁতকে কখনাে আড়াল করতে পারে না। 

দুই থেকে আড়াই বছর বয়সের মধ্যেই শিশুরা ভাঙা ভাঙা শব্দে জড়ানাে গলায় তাদের প্রথম কথা বলা শুরু করে। কিন্তু উপযুক্ত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন আমার মুখে কথা ফুটেনা, তখন গ্রামের সবাই বলাবলি শুরু করে, হায়রে হাওয়া বিবির এমন রাজপত্রের মতাে পােলাডা শেষমেশ কিনা বােবাকালা হইলাে। আফসােস। বড়ই আফসােস। কিন্তু নাহ, বােবা হইনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেশ দেরীতে হলেও একসময় মুখে কথার ফুল ফুটে। কিন্তু নেটওয়ার্কে গােলমাল হলে যে রকম বাফারিং হয়, কথা আটকে আটকে আসে, আমার কথাও তেমন জড়িয়ে যাচ্ছিলাে।

পরে সবাই বুঝতে পারে, হাওয়া বিবির পােলার কথায় গন্ডগােল আছে, অর্থাৎ তােতলামাের সমস্যা আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘স্পিচ ডিসঅর্ডার’। এরপর সবাই যখন  বাবা-মায়ের আকিকা দিয়ে রাখা সুন্দর নামটা কেটে সে জায়গায় তােতলা ট্যাগটা বসিয়ে দেয়, তখন নদীর বুকে শিকারীর খুঁজে বিরামহীন উড়তে থাকা চিলেরও বুঝতে বাকি থাকে না যে, এটা শুধু নিছক সমস্যা নয়, অভিশাপও বটে। 

একটি শিশুর বয়স চার কিংবা পাঁচ পেরােলে কেউ না কেউ তার হাতেখড়ির দায়িত্ব নেয়। প্রথম শিক্ষাটা পরিবারের কাছ থেকেই পায়। অতঃপর যখন বয়স আরেকটু বাড়ে তখন স্কুলের সাথে পরিচয় ঘটে। 

কিন্তু আমি তােতলা হয়ে জন্মানাের দোষে নিদারুণ অবহেলায় হাতেখড়ি কিংবা স্কুল কোনটারই দেখা পাইনি সেই বয়সে। লােকে আমার বাবাকে এসে বলতাে, ওরে লেহাহড়া হিগায়া কি করবা মিয়া? তারচেয়ে ভালা হয় আরেকটু বয়স অইলে একটা জব্বর দেইখা কামে লাগায়া দাও। গতর খাইটা অন্তত দুইডা পয়সা কামাই করতে পারব। কিন্তু আমার বাবা মানুষের কথায় ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও হাল ছেড়ে দেননি। তিনি অতিউৎসাহী ও পরচর্চাকারী ঐ লােকদের বলতেন, তােতলা হইছে দেইখা কি পড়ালেহা হিগতে পাইরবাে না? এইডা কেমুন কথা মিয়ারা। বােবারাও তাে পড়ে, তাইলে আমাগাে ফখর মিয়া ক্যান পাইরবাে না।। 

জন্মের পর থেকে এই সমস্যা নিয়ে একজন মানুষেরই সাহায্য পেয়েছি, তিনি আর কেউ নন, আমার হতভাগা বাবা। তার মনে হয়তাে এই আশা ছিল যে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাপধনও সুন্দর করে কথা বলতে পারবে। 

যার জীবনের শুরুটা আর দশটা শিশুর চেয়ে আলাদা ছিল, তার বিদ্যার প্রথম পাঠও ভিন্নরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাকে নিয়ে বাবার একরাশ স্বপ্ন ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার খেদ। আর তাই যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে গেছেন। 

বাড়ি থেকে বেশ দূরে প্রায় কয়েক কিলােমিটার পথ পেরােলে শহরের দিকে যাওয়ার মূল সড়ক। প্রতিদিন কাক ডাকা ভােরে, বাবা আমাকে নিয়ে ছুটতেন সেই সড়ক পানে। সড়কের দুইধারে সারি সারি করে বিছানাে গাছের গুঁড়ির উপর গিয়ে বসতাম আমরা। তারপর পিচঢালা রাস্তাকেই আস্ত স্লেট বানিয়ে ইটের টুকরাে কুঁড়িয়ে নিয়ে সেখানে একের পর এক বর্ণমালা ফুটিয়ে তুলতেন। এরপর বলতেন, এই হইলাে গিয়া অ, আর এই যে এইটা দেখতাছােস না, এইটা হলাে আ। কি বল বল? আরে বেটা চেষ্টা তাে করবি। আমরা মুর্খ হইছি দেইখা তুইও কি আজীবন মুর্খ থাকবি? তারপর আবারও সকালবেলার মক্তবের হুজুরের মতাে সুর করে বলতেন, অ, আ, ক, খ। এরপর আমিও সুর করে টেনে বলার চেষ্টা করতাম। কারণ তখনও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম না। তাই টেনে টেনে বললে তবুও একটু-আধটু পারতাম। 

এরপর এগুলাে শেখানাে হলে ইংরেজী বর্নমালা এ, বি, সি, সি, ডি একই কায়দায় রপ্ত করাতেন। এভাবে একে একে সবগুলাে বর্ণমালার সঙ্গে সখ্যের পর আমাকে দিয়ে সেগুলাে লেখারও চেষ্টা করাতেন। আমি ইটের টুকরাে দিয়ে আঁকিবুকির চেষ্টা করতাম। হচ্ছিলাে না দেখে বাবা প্রথম প্রথম আমার হাতের উপর নিজের হাত রেখে ঘুরাতেন। এভাবে একসময় লেখতেও শিখে যাই। 

এরপর বর্ণমালা শেষ হলে আমাকে যুক্তবর্ণ এবং বাক্য গঠনও শেখাতেন বাবা। এটির প্রক্রিয়াও ছিল বেশ চমকপ্রদ। সড়ক বেয়ে যত গাড়ি যাতায়াত করতাে, সেগুলাের গায়ে লেখা নাম দিয়েই শুরু হয় আমার বাক্য গঠনের প্রথম পাঠ। আজ এতােদিন পরেও এখনাে মনে আছে তার কয়েকটি নাম, বৈশাখী, ঈগল, বােগদাদ ও পদ্মা। বাবা চলন্ত গাড়িকে দেখিয়ে বলতেন, বলতাে গাড়িটার নাম কি? আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে কয়েকবার ঢােক গিলে ভয়ার্ত গলায় বলার চেষ্টা করতাম, বউ কার বাে দ আ দা দ- বােগদাদ। বাবা মুচকি হেসে বলতেন, বড়ই খুশি করলিরে বাপ। চল আজ তােরে রহিমের দোকান থেকে মালাই খাওয়ামু। 

ইটের টুকরােকে চক আর রাস্তাকে স্লেট বানিয়ে বর্ণমালা শেখার পর তারপর শুরু হয় আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার যাত্রা। ততােদিনে বাপ-বেটা মিলে শব্দ করে জোরে পড়তে পড়তে মুখের জড়তাও কেটে গেছে অনেকটা। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি তারপর উপজেলার কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং সর্বশেষ এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পােস্ট গ্রাজুয়েশনও শেষ করি। 

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এতােটা পথ পাড়ি দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারিগর আমার বাবা। যিনি নিজে স্বল্পশিক্ষিত হয়েও আমাকে শেখানাের বিন্দুমাত্রও ত্রুটি রাখেননি। হাতেখড়ির সেই অমলিন স্মৃতিটুকুনই আজ আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ।

ফখরুল ইসলাম
স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

Skip to content